স্বামী অসুস্থ, সংসারের হাল ধরতে অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় রোজিনা
প্রকাশিত : ১১:০০, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ | আপডেট: ১১:০২, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩
টাঙ্গাইল পৌরসভায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালকদের মধ্যে একমাত্র নারী চালক রোজিনা বেগম। স্বামী অসুস্থ তাই অভাবের সংসারের হাল ধরতে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করতে হচ্ছে তাকে।
টাঙ্গাইল পৌর শহরের রাবনা বাইপাস-বেবিস্ট্যান্ড সড়কে যাত্রী নিয়ে অটো চালাতে দেখা যায় রোজিনাকে। যেখানে পুরুষ চালকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে ৫ বছর ধরে রোজিনা এই অটোরিকশা চালাচ্ছেন।
টাঙ্গাইল পৌরসভা কার্যালয় সূত্রে জানা যাায়, টাঙ্গাইল শহরে চলাচলের জন্য ৪ হাজার ২০০ ইজিবাইক ও ৫ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমতি (লাইসেন্স) দেওয়া হয়েছে। যানজট এড়াতে ৪ হাজার ২০০ ইজিবাইক জোড় ও বিজোড় সংখ্যায় ভাগ করা হয়েছে। সকাল থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত এক ভাগ এবং বেলা দুইটা থেকে রাত পর্যন্ত আরেক ভাগের ইজিবাইক চলাচল করার নির্দেশনা দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু রোজিনাকে দুই শিফটে চালানো নির্দেশ দিয়েছেন পৌর কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অটোরিকশার বসে যাত্রী ডাকছেন রোজিনা। ট্রাফিক পুলিশ অন্য চালকদের অটো দাঁড় করতে না দিলেও রোজিনাকে যাত্রীকে নামাতে দিচ্ছেন। ট্রাফিক পুলিশসহ অটোচালকরা তাকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন।
অটোরিকশার চালক রোজিনা বলেন, ‘আমার অটোতে নারী যাত্রীরা খুব কম উঠে। তারা মনে করে আমার অটোতে উঠলে দুর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু আমার অটোতে ছেলে যাত্রীরাই বেশি উঠে। আমি খুব হিসেব করে অটো চালাই। খুব দ্রুত গতিতেও না, আবার একেবারে ধীরগতিতেও না। এখন পর্যন্ত আমি কোন দুর্ঘটনার কবলে পড়ি নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহরের পুরুষ অটোরিকশা চালকরা আমাকে অনেক সম্মান করে। আমি যখন রাস্তার ওপর অটো ঘুরাই তারা নিজেদের অটো দাঁড় করে আমাকে ঘুরাতে সুযোগ করে দেন। বড় গাড়ির চালকরাও যখন আমাকে দেখেন তখন তারাও আমার প্রতি সম্মান দেখান।’
অটোচালক কাদের মিয়া বলেন, ‘আমাদের শহরে কয়েক হাজার অটো চলাচল করে। তার মধ্যে একমাত্র নারী চালক রোজিনা। তিনি খুব সাবধানে অটো চালান। তাকে আমরা সব সময় সহযোগিতা করি। যদি দেখি সে রাস্তায় অটো ঘুরাচ্ছে তখন আমাদের অটো দাঁড় করিয়ে তাকে ঘুরানো জন্য সুযোগ করে দেই। আমরা চাই, তাকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হোক।’
অটোরিকশার যাত্রী সাইদ মিয়া বলেন, আমি এ পর্যন্ত ৫-৬ বার রোজিনার অটোতে উঠেছি। অটোর চালক নারী দেখেও আমি তার অটোতে উঠি। তিনি খুব সাবধানে অটো চালান। পুরুষ চালকের চেয়ে তার অটো চালানো অনেক ভালো। তাকে যদি সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়। সে একটু ভালোভাবে চলতে পারবে।
আরেক যাত্রী বক্কর মিয়া বলেন, নারী অটোচালকের পাশের সিটে বসতে কিছুটা সংকোচবোধ হলেও তিনি কোন সংকোচবোধ মনে করেন না। তিনি খুব সাবধানে অটো চালান।
রোজিনার সাহসিকতাকে দেখে নারী সংগঠক সিরাজুমমনি বলেন, ‘তিনি অনেক দিন যাবত অটোরিকশা চালান, আমি রোজিনাকে স্যালুট জানাই। একজন পুরুষের চেয়ে একজন নারী কোনো দিকে কম নন, রোজিনা তা প্রমাণ করেছেন। জনপ্রতিনিধি ও সরকারিভাবে তাকে কোন একটা ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে দিলে তার আর রাস্তায় অটো চালাতে হবে না আমি মনে করি।’
অটোরিকশায় বসে কথা হয় রোজিনার সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাবা একজন তাঁত শ্রমিক। তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় সে। অভাব অনটনের সংসারে বাবা-মা তাকে এক এতিম যুবকের সাথে বিয়ে দেন। বিয়ের পর জন্ম হয় দুই কন্যা সন্তানের। অটোরিকশা চালিয়ে কোন রকম সংসার চালাচ্ছিলেন স্বামী রফিকুল ইসলাম। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় রফিকুলের এক চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। আরেকটি চোখ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত চোখের দৃষ্টি শক্তি আরও কমতে থাকে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে অটোরিকশা চালানো।
সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষটি অচল হয়ে পড়ায় স্বামীর চিকিৎসার খরচ, ঘর ভাড়া, খাওয়ার পাশাপাশি মেয়েদের পড়ালেখার খরচ বন্ধ হয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে পরেন রোজিনা। পরে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার তাও চলছিল না। এরপর এনজিও থেকে ধার করে কোন রকম সংসার চালাতে পারলেও মেয়েদের লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ জোগাড় করতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে রোজিনা নিজে অটোরিকশা চালাতে আগ্রহ হয়। স্বামী রফিকুলের কাছে তা শিখতে চান। গ্রামের স্কুলের মাঠে স্বামীর কাছে অটোরিকশা চালানো শিখেন রোজিনা।
পরে গ্রামের পথে ৫-৬ দিন শিখে বাড়ি থেকে অটোরিকশা নিয়ে একদিন সরাসরি টাঙ্গাইল শহরে চলে আসেন রোজিনা। এভাবে ধীরে ধীরে অটোরিকশা চালানো শুরু হয় তার।
রোজিনা বলেন, অটো চালানো চিন্তাটা আমার জন্য খুব সহজ ছিল না। ৫ বছর ও ১০ বছরের দুই মেয়েকে বাড়িতে রেখে অটোরিকশা নিয়ে সারাদিন রাস্তায় থাকতে হয়। তাদের ভালোভাবে দেখাশোনা করতে পারি না। কি করবো অভাবের সংসার। ভাড়া বাড়িতে থাকার খরচ কমাতে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটু জমি কিনি। পরে সেখানে সরকার আমাকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর তুলে দেয়।
রোজিনা আরও বলেন, যখন খুব অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছিলাম তখন মানুষ আমাদের ঠাট্টা করেছে। যখন জীবনের তাগিদে অটোরিকশা চালাতে শুরু করি তখনও নানা কথা বলেছে। তবে এখন তারাই আমাকে সম্মান করেন। নারীরাও কিছু করতে পারে।
তিনি বলেন, আমার দুই মেয়ে বড় মেয়ে আইসড়া উচ্চ বিদ্যালয় পড়ে ছোট মেয়ে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। আমার তো থেমে গেলো চলবে না। মেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে। ধারদেনা শোধ করতে হবে। আমি অটোরিকশা চালিয়ে দুই সন্তানকে মানুষ করতে চাই। আমার পাশে যদি সরকার দাঁড়ায় তাহলে আমি অটোরিকশা চালানো বাদ দিয়ে অন্য কোন কাজ করবো।
টাঙ্গাইলের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) দেলোয়ার হোসেন বলেন, শহরের একমাত্র নারী চালক রোজিনা। কেউ যেন তাকে বিরক্ত করতে না পারে সেদিকে ট্রাফিক পুলিশ সব সময় নজর রাখে। আমাদের ট্রাফিক পুলিশ তাকে সব সময় সহযোগিতা করে আসছে।
টাঙ্গাইলের সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহ আলম বলেন, আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারলাম। ওই নারী এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসে নাই। সে যদি আমাদের কাছে এসে আবেদন করে অবশ্যই তাকে আমরা সহযেগিতা করবো, তার পাশে দাঁড়াবো।
এএইচ
আরও পড়ুন