পর্ব-১
স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট: ভয়াবহ আসক্তির শিকার ব্যবহারকারীরা
প্রকাশিত : ১৬:৫৫, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৯:২৪, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮
স্মার্টফোন বর্তমান সময়ের এক অপরিহার্য অংশ। তথ্যপ্রযুক্তির এ ছোঁয়ায় জনজীবনে যেমন গতিশীলতা এসেছে তেমনি এর অপব্যবহারের কারণে নেতিবাচবক প্রভাব পড়ছে আরও বেশি। দিন দিন আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে এই স্মার্টফোন। শিশু থেকে বয়ঃজ্যেষ্ঠ সব বয়সীদের মাঝে স্মার্টফোন আসক্তি এখন চরম পর্যায়ে। শিশু-কিশোরেরা পড়ার টেবিলে মুঠোফোনেই সময় বেশি ব্যয় করছে। আবার অভিভাবক মুঠোফোন নিয়ে নিলে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে এসব শিশু-কিশোরেরা। রাত জেগে স্মার্টফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের সাইটে বা ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করেছে। এতে সময় অপচয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্যের উপরে পড়ছে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব। ক্লাসে বা পড়শুনায় ঠিক মতো মনোযোগ দিতে পারছে না। অন্যদিকে প্রাপ্ত বয়স্করাও অফিস চলাকালীন সময়ে কাজ বাদ দিয়ে পরে থাকছেন ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইউটিউবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দৈনন্দিন কাজকর্ম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক নাগাড়ে বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করলে এর থেকে নির্গত গামা রশ্মির প্রভাবে দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। সেই সাথে মানসিক বিষন্নতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যতে দৈনন্দিন কার্যকর্মের অনীহা তৈরি হয়। মেজাজে অনেক সময়ই থাকে খিটখিটে। তাই স্মার্টফোন ব্যবহারের সবাইকে সচেতন হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
শাহবাগ মোড়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র আবদুর নুর। হঠাৎ তার পাশ দিয়ে সজোরে বেরিয়ে গেল একটি প্রাইভেটকার। অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন নুর।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, মুঠোফোন ব্যবহার করতে করতেই কোন দিকে খেয়াল না করেই সড়ক পার হচ্ছিলেন নুর। অনেকটা চালকের দক্ষতায় এড়ানো গেছে দুর্ঘটনা।
নুরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেসবুকে তার এক বন্ধুর সঙ্গে চ্যাট (তাৎক্ষণিক বার্তালাপ) করছিলেন তিনি। চ্যাট করতে করতেই সড়ক পার হচ্ছিলেন কেন জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। তবে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করে বলেছেন ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবেন।
নুরের মত এমনই স্মার্টফোন আসক্তিতে আছে দেশের হাজার হাজার মানুষ। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা। নুরের মত সবাই এমন ‘দ্বিতীয় সুযোগ’ পান না।
বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার মধ্যে ৩০ শতাংশ মানুষ এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। অর্থ্যাৎ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের হাতে আছে স্মার্টফোন। মুঠোফোন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, আগামী পাঁচ বছরে এ সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছাবে। অর্থ্যাৎ প্রায় ১০ কোটি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করবে।
বিশাল এই ব্যবহারকারীর জন্য কম দামে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থাও নিচ্ছে সরকার। তাই সহজেই অনুমান করা যায় যে, সামনের দিনগুলোতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর পাশাপাশি স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাবে।
তবে স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার দিন দিন ‘আসক্তি’র পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং শিশুদের মধ্যে অনেকটা ‘মাদকাসক্তির’ মতই প্রভাব ফেলছে বিষয়টি।
স্মার্টফোন এবং ফেসবুক
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা বললে শুরুতেই যার নাম আসবে তা হল ফেসবুক। স্মার্টফোন যারা ব্যবহার করেন তাদের বেশিরভাগই এই ফেসবুকে অনেক সময় ব্যয় করে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা তৈরি করার প্রজেক্ট থেকে শুরু হয়ে আজ তা বিশ্বের এক নম্বর ওয়েবসাইট। ফেসবুকে একজন ব্যবহারকারী তার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুমহলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবেন যার মাধ্যমে তৈরি হবে সামাজিক যোগাযোগ। এমন একটি ধারণা থেকে তৈরি হলেও ফেসবুকই এখন অনেক অসামাজিক কর্মকাণ্ডের উৎসস্থল।
নিজস্ব পরিমন্ডলের গণ্ডি পেরিয়ে এখন ফেসবুক নিজেই এক বিশাল দুনিয়া।
তরুণদের ওপর প্রভাব
আমাদের দেশে স্মার্ট মুঠোফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ-তরুণী। অনেকের কাছেই মুঠোফোন এমন এক যন্ত্র যা ছাড়া একটা দিনও ভাবতে পারেন না তারা। পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি অথবা ব্যবসার কাজেই অনেকে স্মার্টফোন ব্যবহার করে থাকলেও সে সংখ্যা খুবই অল্প।
বেশ কয়েকজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিজেদের একাকী সময় অথবা বিষন্নতার সময়ে তারা ফেসবুকে সময় ব্যয় করেন। বাস্তব জগতের সামাজিক উপাদানগুলোতে যুক্ত থাকার চেয়ে ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যমে “অ্যাকটিভ” থাকতেই বেশি পছন্দ করে এখনকার তরুণ সমাজ।
মিরপুরের ষাটোর্থ ব্যবসায়ী জিয়া উদ্দীন বলেন, “আগে পাড়া মহল্লা বা পরিবারের অনুষ্ঠানে আমরা অংশ নিতাম। বলতে গেলে অনুষ্ঠান আমরাই মাতিয়ে রাখতাম। এখন আমাদের ছেলেদের দেখি তারা এসব অনুষ্ঠানে যেতেই চায় না। যদি যায়ও তাহলে ওই মোবাইল নিয়েই এক কোণায় বসে থাকে। আবার কাউকে দেখি শুধু সেলফি আর খাবারের ছবি তুলে ফেসবুকে দেওয়ার জন্যই এসব অনুষ্ঠানে যায়। এরা ফেসবুক, ইন্টারনেট ছাড়া আর কিছুই বোঝে না”।
শিশুদের ওপর প্রভাব
রাজধানীর পান্থপথে বসবাসরত ব্যবসায়ী রিপন মজুমদারের মেয়ের বয়স দুই বছর। মুঠোফোনের ইউটিউবে গান চালু না থাকলে রাতের খাবার খায় না জাওয়ারা। এমন কি মুঠোফোন ব্যবহার করে ইউটিউব ব্যবহারে পুরো পারদর্শী এই শিশু। রিপন মজুমদার ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “আগে দেখতাম ছোট বাচ্ছারা টিভিতে টম অ্যান্ড জেরি বা মিকি মাউসের কার্টুন দেখত। এখন দেখি তারা মুঠোফোনে ভিডিও দেখে। মুঠোফোন না দিলে কান্নাকাটি করবে। খাবেও না। এখন আমি বুঝতেছি না যে, অভিভাবক হিসেবে কী করব?”
শিশুদের ওপর স্মার্টফোনের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়ে সরব হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও। শীর্ষ মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপলে বিনিয়োগ করা দুই প্রতিষ্ঠান শিশুদের মুঠোফোন ব্যবহারে অভিভাবকদের সতর্ক এবং সচেতন করতে অ্যাপস নির্মাণের অনুরোধ করে প্রতিষ্ঠানটিকে। জেনা পার্টনার এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার টিচার্স রিটায়ারমেন্ট সিস্টেম নামের ওই দুই প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি অ্যাপলকে এক চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ করে যে, অ্যাপল যেন এমন এক সফটওয়্যার বানায় যা দিয়ে শিশুদের বয়স এবং মুঠোফোন ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করা যায়।
আবার মুঠোফোন ব্যবহারের কারণে স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে শিশুদের মধ্যে। ছোটবেলা থেকেই মুঠোফোনের দেওয়া তথ্যের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে যাওয়াতে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে কোন চর্চা তারা করে না।
মুঠোফোন এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি
চিকিৎসকেরা বলছেন, মুঠোফোন ব্যবহারের কারণে মানুষদের মাঝে স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলছে। অতিরিক্ত মুঠোফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে মানুষদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা দিনে ১৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ফোনের পেছনে ব্যয় করেন তাদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি।
ডাক্তার রামেন গোল বলেন, “আমরা এক গবেষণায় নিশ্চিত হয়েছি যে, সেলফোনের অধিক ব্যবহারে শারীরিক কর্মকাণ্ড কমে যায় এবং ফিটনেসের জন্য হুমকি”।
ভারতের জাসলক হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্রের সার্জন সঞ্জয় রয় এক গবেষণাপত্রে বলেন, “এই গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে, সেলফোন ব্যবহারকারীদের অনেকেরই ফোনের প্রতি এক ধরনের আসক্তি তৈরি হয়, যার ফলে সময় মতো খাবার খাওয়া বা ভ্রমণ করার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ থাকে না। অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের জন্যও ওজন বৃদ্ধি পায় এবং নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়ে এই সমস্যায় বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে”।
এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদী ফোন ব্যবহারে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন তারা বড় হয়ে অনেকে দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না।
অনেকেই আবার স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের কল্যাণে নিজেই ডাক্তার বনে যান। ইউটিউবের ভিডিও দেখে নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা করেন। দোকান থেকে নিয়ে আসেন ওষুধ। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফলাফল হয় ভয়াবহ। ইউটিউবের ভিডিও দেখে ওষুধ কিনে খেয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন নজিরও আছে খোদ আমাদের বাংলাদেশেই।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
মুঠোফোন এবং ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক ড.মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, “সত্যিকারের মাদকাসক্তির সঙ্গে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আসক্তির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।”
সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা শন পার্কারের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে জাফর ইকবাল বলেন, “শন পার্কার বলেছেন যে, শুধু খোদাই বলতে পারবে আমরা না জানি পৃথিবীর শিশুদের মস্তিষ্কের কী ক্ষতি করে যাচ্ছি”।
মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুহিত কামাল ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ বিষয়ে কাজ চলছে। আমাদের কাছেও মতামত চাওয়া হয়েছে। আমরা সবাই একটি বিষয়ে একমত হয়েছি ক্ষেত্রবিশেষে ফেসবুক বা ইন্টারনেট ব্যবহার আসক্তির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আমরা এটাকে বলি ‘নেট এডিকশন ডিসঅর্ডার’।
“ডিসঅর্ডারের কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকবে। যখন কোন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত অথবা সত্যিকার অর্থেই কোন কাজের উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট বা ফেসবুক ব্যবহার করেন তখন কিন্তু তা ডিসঅর্ডার না। অনলাইনে আমরা অনেক কাজ করছি। তবে এসব ইতিবাচক ব্যবহারের বাইরে মানুষ অনেক সময়ই ‘নেশাগ্রস্ত’ হয়ে যায়”।
ইন্টারনেট অথবা মুঠোফোনে আসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন ডা. মুহিত কামাল।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহা বলেন, “মানুষ যেভাবে ইন্টারনেটে ঝুঁকে পড়ছে তা সত্যিকার অর্থেই আসক্তির মত। এটি আমাদের স্বাভাবিক কাজেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তবে সবথেকে ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। আমার মতে ১৮ বছর বয়সের নিচের শিশু-কিশোরদের জন্য মুঠোফোন নয়। মুঠোফোন দিলেও তার ব্যবহার সীমিত করা উচিত। শিশুদের মানসিকতা বিকাশের অন্তরায় এই ইন্টারনেট”।
পাশাপাশি স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের যথাযথ ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম। তিনি বলেন, “বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এর ব্যবহার যেন সঠিক এবং ভাল কাজ লাগে সেদিকে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। সবকিছুরই ভালো এবং মন্দ দুই দিক থাকে। প্রযুক্তিরও খারাপ দিক আছে। সেটিকে ভালভাবে ব্যবহার করার দায়িত্ব আমাদেরই”।
এর পরবর্তী অংশ পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে।
এসএইচ/টিকে