ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

স্মৃতিতে বিসমিল্লাহ খান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৫২, ৩১ আগস্ট ২০২০

ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান

ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান

Ekushey Television Ltd.

উপমহাদেশের বিশ্ববিশ্রুত সানাইবাদক ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গত ২১শে আগস্ট, শুক্রবার। এর সঙ্গে ওস্তাদের বারানসির (বেনারাস) প্রিয় স্মৃতিময় বাড়িটি প্রমোটাররা ভাঙা শুরু করেছে বলে একটি দুঃখজনক খবর চলে আসে। এই দুই প্রসঙ্গে তাঁকে ফেসবুকে অনেকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, মন্তব্য করছেন। ওস্তাদকে নিয়ে আমার একটি মজার স্মৃতি মনে পড়লো।

আমার দুই কন্যার একেবারে শিশুকাল থেকে, যখন ওরা ব্যাপারটা বুঝতেই শেখেনি তখন থেকে, ঢাকায় কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি এলে, যাঁদের হয়তো আর কখনো পাবো না তাঁদের অটোগ্রাফ নিয়ে রাখতাম ওদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে, ছবিও তুলতাম। সব সময় সফল হইনি, আবার হয়েছি। বেশ কিছু গল্প আছে। আজ শুধু বিসমিল্লাহ খান সন্নিধানে যাওয়ার গল্পটা বলি।

২০০০ সালের শেষভাগে ওস্তাদজী ঢাকায় এলেন মাত্র চার দিনের জন্য। যতদূর মনে পড়ে, তাঁর বাদন থেকে অর্জিত টাকা সে-সময়ের কোনো জরুরি জনকল্যাণে ব্যয় হবে। তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে মহাখালিতে ব্র‍্যাক সদর দফতরের ভবনে ব্র‍্যাক ইনে। সাংবাদিকতা পেশায় থাকায় আমার সেকথা জানা ছিল। মেয়েরা ক্লাস সিক্সে পড়ে। দুপুর পর্যন্ত স্কুল। তারিখটা ১৯শে নভেম্বর। ওস্তাদজি বিকেল চারটায় বেরিয়ে যাবেন অনুষ্ঠানের জন্য। 

বাসায় যেতে না দিয়ে মেয়েদের স্কুল থেকেই নিয়ে ছুটলাম। তখন গাড়ি ছিল না আমার। রাস্তার জ্যাম ঠেলে স্কুটারে পৌঁছে গেলাম সৌভাগ্যবশত। রিসেপশনে প্রয়োজনীয় প্রশ্নের জবাব দিয়ে ত্রস্তে লিফট ধরে চার তলায় উঠে ধড়ে পানি এলো, ওস্তাদজী আছেন। ঘরের বাইরে জনা চারেক অপেক্ষমান লোক। দরজার কাছে একজন পরনে চুড়িদার পাজামা, পায়ে নাগরা, সাদা পাঞ্জাবির ওপর কালো ওয়স্টকোট চাপানো। উত্তেজনাবশে তাঁকে ওস্তাদজী ভেবে সমীহর সঙ্গে সালাম দিয়ে পা ছুঁয়ে কদমবুচি করলাম। তিনি স্মিত হেসে বললেন, কেয়া বেটা, ওস্তাদজী কো মুলাকাত চাহিয়ে? আভি রেস্ট করতে হ্যায়। ব্যাঁয়ঠো। বুঝিয়ে বললেন, আমরা ঘরে যাবো না। তিনি একটু পরেই বাইরে যাবেন, তখন দেখো। আমি অটোগ্রাফের কথা বলে রাখলাম।

আমরা সেখানে রাখা চেয়ারে বসলাম। বুঝলাম আমি সচিবকেই পেন্নাম ঠুকে দিয়েছি। বেশিক্ষণ বসতে হলো না। সচিব ভেতরে গেলেন এবং ওস্তাদজীকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। হুইল চেয়ারে বসা। ছোট দুটি মেয়েসহ আমাকে দেখিয়ে দিলেন। আমরা পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। সচিব ইশারা করলেন যে তাড়া আছে। সচিব ওস্তাদজীর হাতে একটা কলম দিলেন। আমি পরমা-উপমাকে এগিয়ে দিলাম। উপস্থিত সহৃদয় একজন বললেন, আমাকে ক্যামেরাটা দেন, আপনিও দাঁড়ান। ফলে মেয়েদের পেছনে দাঁড়িয়ে আমার ছবিও তোলা হয়ে গেল। পরে দেখি, বিসমিল্লাহ খান সাহাবের সচিব সাহবের ছবি পুরো আসেনি। তিনি আমার পাশেই ছিলেন। 

আরও মজার ব্যাপার হলো, আমার কন্যাদ্বয়ের মা ব্র‍্যাকেরই কর্মী। তিনি সতের তলায় অফিস করছিলেন। আমরা আওয়াজ দেইনি। আমাদের এই অভিযানের কথা তিনি জানতে পারেন বাসায় ফিরে রাতে।

কিছু কথা:  ফুঁ দিয়ে বায়ু সঞ্চালনে বাজাতে হয় এমন একটি বাঁশীধর্মী সাদামাটা লোক-বাদ্যযন্ত্র, যা বিয়ের আসরে বাজানো হতো, সেই সানাইকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাহফিলে ওঠানো শুধু নয়, আন্তর্জাতিক সংস্কৃতিতে স্থাপন করে কনসার্টের মঞ্চে নিয়ে গেছেন বিসমিল্লাহ খান বস্তুত একক চেষ্টায়। ৭০ বছর বাজিয়েছেন। তাঁর সাধনায় ভারতাত্মার সুর ধ্বনিত হয়েছে এই অর্থে যে, নিষ্ঠাবান ধার্মিক শিয়া মুসলিম হয়েও বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্ম-সংস্কৃতির মিলন ঘটিয়েছেন নিজের মধ্যে। বারানসিতে গঙ্গাস্নান করে তাঁর দিনের সূচনা। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। ঘাটে ও মন্দিরে সানাই বাজিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহেরুর অনুরোধে ১৯৫০ সালে ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির লালকেল্লায় উন্মুক্ত জনসমাবেশে সানাই বাজানো তাঁর গভীর দেশপ্রেমের পরিচয়, যা ধরে রেখেছিলেন আমৃত্যু। বিদেশে যেতে চাইতেন না। সরকারের অনেক অনুরোধে রাজি হয়ে বিলেতের এডিনবরায় প্রথম কনসার্টে যাওয়ার আগে শর্ত দিয়ে সরকারি খরচেই মক্কা ও মদিনা হয়ে যান। 

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একাধিক মহারথী যেখানে স্থায়ীভাবে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে চলে গেছেন সেখানে বিসমিল্লাহ খান দিল্লিতেও থাকতে রাজি হননি। বিহারে জন্ম, কিন্তু বেড়ে ওঠার জায়গা উত্তর প্রদেশের বারানসিতে জীবনযাপন করে সেখানেই দেহরক্ষা করেছেন। সাদাসিধে অন্তর্মুখী স্বভাবের এই জগৎবিখ্যাত মানুষটির অটোগ্রাফ এত সহজে অন্তরঙ্গ পরিবেশে দু'টি  শিশু নিতে পেরেছিল, সে-ও সৌভাগ্য মানি।

বারানসিতে বিসমিল্লাহ খানের প্রিয় বাসভবন, দীর্ঘকাল রেওয়াজের ঘর, ভেঙে গুঁড়িয়ে আধুনিক মার্কেটপ্লেস তৈরি হচ্ছে। সানাইসহ ওস্তাদজীর ব্যবহৃত জিনিসও সুরক্ষিত হয়নি। তাঁর নাতিরা এই ঐতিহ্যবিরোধী সংবেদহীন কাজটি করছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ পায়ে ঠেলে ঐতিহ্য রক্ষায় আগ্রহ দেখানো কঠিন বটে। ওই বাড়িতে সংগ্রহশালা ও সংস্কৃতিকেন্দ্র তৈরি হতে পারতো। সে দায়িত্বটা তো উত্তর প্রদেশ বা দিল্লি সরকারের, যাতে বংশধররা পুরোপুরি আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। উভয় জায়গাতেই অবশ্য এখন সংকীর্ণমনা উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা ক্ষমতায়। বর্তমান ভারতে বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের সুর প্রেতের চিৎকারে ঢাকা পড়ে যেতে পারে।

লেখক: প্রবীণ সাংবাদিক

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি