ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

স্মৃতিময় বিবিসি রেডিও

রফিকুল বাহার

প্রকাশিত : ২০:১৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ | আপডেট: ২০:১৮, ৩০ ডিসেম্বর ২০২২

বিবিসি মানে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন। ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে চলে এই মিডিয়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ সহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই মিডিয়ার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সাধারণ শ্রোতাদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত।

আমি তখনো ছোট। ক্লাস ওয়ান কিংবা টু তে পড়ি। পুরো স্মৃতি মনে নেই। গ্রামের বাড়িতে থাকা তিন ব্যান্ডের ছোট রেডিওতে বিবিসির খবর শুনবার জন্য অনেক কষ্ট করে ফ্রিকোয়েন্সি পেতে হত। সকাল ৭ টায় আর রাতের সাড়ে দশটার খবর ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আধঘন্টা করে দিনে দুইবার এক ঘন্টার খবর শুনবার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকতেন আমার দাদা চাচারা। বিশ্ব সংবাদ জানার জন্য এটি ছিল সেই সময়ে তাদের কাছে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম। প্রযুক্তি এখনকার মতো আধুনিক না হওয়ায় রেডিওতে সেই খবরের পুরোটা স্পষ্ট শোনা যেত না। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে পরিস্থিতি অনেক পাল্টে যায়- সুস্পষ্টভাবে শোনা যেত বিবিসির খবর।

বিবিসি রেডিওতে বাংলা সংবাদ বা খবর শুনতে শুনতে আমারও মনে হতো যে এত দূর থেকে কত সুন্দর বাংলায় খবর জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে! কিভাবে এটি সুচারুভাবে শেষ করছে এই নিয়ে আমার কৌতূহলের কোন সীমা ছিল না।

লেখাপড়া শেষে বড় হয়ে যখন সাংবাদিকতা করতে শুরু করি চট্টগ্রামে তখন মনে হতে থাকে যে আমি কোন একদিন বিবিসিতে কাজ করব? আমি তখন ভোরের কাগজে খেলাধুলা বিষয়ক রিপোর্টের পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক সংবাদও করতে শুরু করি সঙ্গে ক্রাইম রিপোর্ট ও। লন্ডন বিবিসিতে কাজ করতেন চট্টগ্রামের ছেলে কৌশিক শংকর দাস। তিনি চট্টগ্রামে এসে কয়েকটি রিপোর্ট করেছেন। সেটি ৯০ এর দশকের শেষ দিকে। কৌশিক কে আমরা ডাকতাম শাম্মী নামে। এটি তার ডাকনাম। এখন তিনি নাটক সিনেমা নিয়েই কাজ করেন। চট্টগ্রামে বিভিন্ন ধরনের রিপোর্ট করার সময় কৌশিক আমার সহায়তা চাইলেন কিংবা আমি তার সঙ্গী হলাম বিভিন্ন স্পটে। বিবিসির সঙ্গে আমার যোগ সূত্র এভাবেই ঘটে। এরপর আস্তে আস্তে চট্টগ্রামের ছোট খাটো ঘটনা জানবার জন্য ঢাকা বিবিসি অফিস থেকে মাঝেমধ্যেই ফোন করা হতো আমাকে।

বিবিসি লন্ডন হেড অফিসের ভেতরে বাংলা বিভাগের প্রধান সাবির মোস্তফার সঙ্গে রফিকুল বাহার ও তার ছেলে লন্ডনে অধ্যায়নরত ইবতেসাম ইফাজ। ছবিটি ২০১৮ সালের ১২ ই অক্টোবর তোলা।  এর কয়েক বছর পর থেকে নিয়মিতই চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ অর্থাৎ লাইভ করা শুরু করল বিবিসি। বিনিময়ে লন্ডন থেকে সে দেশের মুদ্রায় অর্থাৎ পাউন্ডে চেক পাঠানো শুরু করল। বিবিসির খামে চেক যেদিন পেতাম সেদিন অন্যরকম এক আনন্দ হতো মনে। নিজেকে ধন্য মনে হতো ভাবতাম আমি অনেক সৌভাগ্যবান। বিবিসির লন্ডন ও ঢাকা অফিসের সিনিয়াররা বেশ সহায়তা করেছেন যেটি আমার আসলে কোনভাবেই প্রাপ্য ছিল না।

ব্যক্তিগত কাজে কখনো দেশের বাইরে গেলে বিবিসির ঢাকা অফিসের কাদির কল্লোলকে বলে যেতাম। তিনি বলতেন বিদেশে গিয়েই সেখানকার নম্বর যেন জানিয়ে দিই। কোন সমস্যা যদি থাকে বিদেশে আপনার আশেপাশে সেটিও আমাদেরকে জানাবেন- এরকম পরামর্শ দিতেন কাদির ভাই। ভোরের কাগজে আমি কাদির ভাইয়ের সহকর্মী ছিলাম একসময়। ভোরের কাগজের চাকরি ছেড়ে কাদির ভাই বিবিসি ঢাকা অফিসে নিয়মিত সংবাদদাতা হিসাবে যোগ দেন।

এইভাবেই অন্তত দুটি ঘটনা আমি বিদেশে বিবিসির হয়ে কাভার করেছি। থাইল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুরো থাইল্যান্ড জুড়ে তখন উত্তেজনা। ঠিক ওই সময়ে আমি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে গিয়ে পৌঁছাই। ব্যাংককের দোকান থেকে মোবাইলের সিম কিনে সেই নাম্বারে ফোন করে জানিয়ে দেই ঢাকায়। কিছুক্ষণ পরেই ঢাকা থেকে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয় লন্ডন থেকে ফোন করা হবে লাইভে জেনে নেওয়া হবে ব্যাংককের সেই সময়ের পরিস্থিতি আমি যাতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে তখন থমথমে অবস্থা সাধারণের চলাচল ঠিকই ছিল। কিন্তু রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্যাংক নিয়েই চলছিল সেই সব সেনা টহল। সান্ধ্যকালীন নিউজ এর সময় আমাকে লন্ডন থেকে ফোন করে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করা হয়। ব্যাংককের রাস্তার পাশে একটি দোকানের ভিতর দাঁড়িয়ে পুরো পরিস্থিতির বর্ণনা দিলাম আমি। টানা দুই দিন এভাবেই পুরো ব্যাংককের পরিস্থিতি তুলে ধরেছিলাম বিবিসি বাংলার রেডিওতে। ব্যাংকক থেকে দেশে ফিরে আসার পরে অনেক বন্ধু বান্ধব জানিয়েছেন যে তারা ব্যাংকক থেকে আমার দেওয়া সমস্ত ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন তখন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল আমি যখন ২০০৯ সালে সৌদি আরবের মক্কায় হজ পালন করতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে যথারীতি ঢাকা অফিসকে জানিয়ে যাই 
যে, আমি হজে যাচ্ছি এবং বাইশ দিনের মতো সেখানে অবস্থান করব। সেই বছর অসময়ে সৌদি আরবের জেদ্দায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় যেটি ছিল মরুভূমির বুকে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। প্রবল বৃষ্টিতে পানির জোয়ারে ভেসে যায় অন্তত শত শত গাড়ি এবং মারা যায় কয়েকশো মানুষ। মিনায় বসে আমাকে এর বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করে জানিয়ে দিলাম ঢাকায়। এরপর লন্ডন থেকে ফোন করে আমার কাছ থেকে সৌদি আরবের সমস্ত ঘটনার বর্ণনা জেনে নিলেন। সেই খবর সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বিবিসিতে।

মিডিয়া হিসেবে বিবিসি সারা পৃথিবীতেই এক মর্যাদা ও পেশাদার সাংবাদিকতার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে মনে করা হয়। প্রায় ১২ বছর আগে আমি যখন প্রথমবার লন্ডনে গিয়েছিলাম তখন এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল লন্ডন বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে। দীর্ঘ লাইন অতিক্রম করে ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে যখন গিয়ে দাঁড়াই আমার বাংলাদেশি সবুজ পাসপোর্ট দেখেই আমাকে নানাভাবে প্রশ্ন করে হেনস্থা করার চেষ্টা করা হচ্ছিল। এর মধ্যে দেখা যায় অন্যান্য কাউন্টারে বাংলাদেশি ছাত্রদের অর্থাৎ স্টুডেন্টদের আলাদা করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করা হচ্ছিল তখন স্টুডেন্টদেরকে এবং ইমিগ্রেশন থেকে কোন অবস্থাতেই তাদেরকে ছাড় দেওয়া হচ্ছিল না। এইসব দেখে আমি বেশ নার্ভাস হয়ে পড়ি। 

ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে এক পর্যায়ে আমি নিজ থেকেই বলি যে আমি বিবিসিতে কাজ করি বাংলাদেশে। এই কথা শুনবার পর ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার মনে কি এক সহৃদয়তার ভাব লক্ষ্য করা গেল। তিনি হেসে পাসপোর্ট এর সিল মেরে আমাকে বললেন হেভ এ নাইস ট্রিপ। লন্ডনের ৬ মাসের ভিসার আর মাত্র চার দিন মেয়াদ ছিল তাই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার প্রশ্নে আমি ভয় পাওয়ার এটিও একটি অন্যতম কারণ। তবে আমার সাহসের জায়গা ছিল যে আমার রিটার্ন টিকেট ছিল সঙ্গে।
২০১৯ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া এক রোমাঞ্চকর ঘটনা দিয়ে আমি বিবিসিতে অন্যরকম এক সংবাদ প্রচার করার সুযোগ পেয়েছিলাম। 

রাতের সংবাদে ঠিক শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বিমান হাইজ্যাক করে নিয়ে আসা আকাশের সেই দুর্দান্ত কাহিনী আমি বিবিসি তে তুলে ধরে ছিলাম। এর কিছুক্ষণ পরে জানা গেল আকাশ নামের যেই ছেলেটি বিমান ঢাকা থেকে হাইজ্যাক করে নিয়ে আসে তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যাত্রীরা ও তখন নিরাপদে বিমান থেকে নেমে পড়েছে। এই খবর ঢাকা বিবিসি অফিসে জানানোর পরপরই আমাকে বলা হয় যে আপনি সব ধরনের খোঁজ নিয়ে রাখবেন আমরা এই রাতের সংবাদে শেষ পর্যায়ে লাইভ করে অনুষ্ঠান শেষ করব। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে লন্ডন থেকে ফোন করে এই সংবাদের অর্থাৎ এই চাঞ্চল্যকর খবরের পুরোটাই বিবিসি জানিয়ে দেয় সারা বিশ্বের বাংলা ভাষীকে। আমার প্রায় ৩০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে আধা ঘন্টার বিশ্বসংবাদে বিবিসির মতো এরকম সংবাদ মাধ্যমে ২ দফায় লাইভে ঢোকার ঘটনা আর কখনোই ঘটেনি। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা বিবিসিকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যেবার ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছিল সেই নির্বাচনী সংবাদ কাভার করবার জন্য আমি একুশে টিভির পক্ষ থেকে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে হঠাৎ করেই দেখা মাসুদ হাসানের সঙ্গে তিনি বিবিসি লন্ডন থেকে গিয়েছেন আমেরিকার নির্বাচন কাভার করতে। নিউইয়র্কে এয়ারপোর্ট এর পাশে একটি হোটেলে আমি ও হাসান ভাই একসঙ্গে অবস্থান করে সংবাদ দিতে থাকি। আমি বাংলাদেশের একুশে টেলিভিশনের জন্য আর মাসুদ হাসান দিচ্ছিলেন বিবিসি লন্ডনের জন্য। নিউজ শেষে রাতে ডিনারের পর আমাদের এক আনন্দ আড্ডা হতো। কত কথা কত স্মৃতি সেসময় বিবিসি নিয়ে।

বিবিসি লন্ডন অফিসে গিয়েছি বেশ কয়েকবার বাংলা বিভাগের নেতৃত্বে থাকা সাবির মোস্তফা, মানুসী বড়ুয়া, কামাল আহমেদ, মিজানুর রহমান সহ প্রায় সবার সঙ্গে কম বেশি হৃদ্যতা ছিল। দক্ষতা নিরপেক্ষতা নিরাপত্তা ব্যবস্থা পেশাদারী মনোভাব সব মিলিয়ে বিবিসি এমন একটি মর্যাদাপূণ পেশা। বিবিসি বেশ কয়েকবার ঢাকায় তার সংবাদদাতাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। সেসব প্রশিক্ষণকর্মশালাতে আমি নিয়মিত যোগ দিয়েছি ।এমনও দেখা গেছে মাত্র ১০ জন সংবাদ কর্মীকে সংবাদের খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য লন্ডন থেকে হাই প্রোফাইল দুজনকে নিয়ে আসা হয়েছে। এরকম পেশাদারী মনোভাব দেখানোর দৃষ্টান্ত দেখা গেছে শুধুমাত্র বিবিসিতে।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি