স্মৃতির পাতায় প্রিয় শিল্পী সুবীর নন্দী
প্রকাশিত : ১৩:৪৪, ৭ মে ২০২০
দিনটি ছিল ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল। সেদিন একুশে টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘একুশের সকাল’-এ অতিথি হয়ে এসেছিলেন দেশ বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী সুবীর নন্দী। অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের সঙ্গে কিছু সময় গল্প করা এবং তা থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা ছিল আমার নিত্যদিনের রুটিন। কিন্তু সেই সকালটি ছিল আমার জন্য ‘বিশেষ’। ‘বিশেষ’ এ কারণ যে- সেই ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভাল’ সহ অসংখ্য গানের কণ্ঠ যোদ্ধার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবো। যার কণ্ঠ শুনে বড় হয়েছি, তাকে আজ সামনা সামনি দেখবো। বিনোদন বিভাগে কাজের সুবাদে অনেক শিল্পীর সঙ্গেই পরিচয় ঘটেছে। তবে সুবীর দা এই প্রথম। তাই আবেগ ও আগ্রহটা বেশি কাজ করছিলো।
আমি ইটিভির মেকআপ রুমে অপেক্ষায় আছি। লাইভ অনুষ্ঠান শেষে তিনি স্টুডিও থেকে মেকআপ রুমে আসলেন। সবাই তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। আমি সংকোচবোধ করছিলাম। জরসরো হয়ে একপাশে দাঁড়ানো। অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকেও ডাকলেন- বললেন ‘আসেন’। ছবি তোলার পর আমি নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করতেই তিনি আমাকে পাশে নিয়ে বসালেন। এতো বড় একজন তারকা শিল্পী কিন্তু অতি সাবলিল তার ভাষা ও আন্তরিকতা। নিজে থেকেই সব বলতে লাগলেন। পুরানো দিনের স্মৃতি, বর্তমানে গানের অবস্থা, সেই সময়ে তার ব্যস্ততা ইত্যাদি অনেক বিষয়ে কথা হলো। নিজে থেকেই অনেক কথা বললেন। অনেকটা আক্ষেপ করেই বললেন, ‘গানের বর্তমান অবস্থা কি? বেঁচে থাকার মত গান হচ্ছে কই? অনেকেইতো গান করছে স্থায়ীত্বকাল কত দিন? অথচ আগের দিনের গানগুলো দেখুন, হাজার বছর বেঁচে থাকবে। ওইসব গানের কথা, সুর কতইনা মিষ্টি ও হৃদয় ছোঁয়া ছিল।’
আমি বললাম, ‘আপনাদের মত গুনি মানুষ যদি একটু তরুণদের পাশে দাঁড়ান তবে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন করা সম্ভব।’
তিনি হেসে বললেন, ‘সেই সময় কি নতুনদের আছে? তারা শুরুতেই অর্থ ও খ্যাতির পেছনে ছোঁটে। গান হচ্ছে- আত্মার কথা। গান হচ্ছে- আবেগের কথা। গান জীবনের কথা বলে। এটি সাধনার বিষয়। সাধনা না থাকলে গলায় বেঁচে থাকার মত গান জন্ম নেয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কণ্ঠকে যদি সচল রাখতে হয় চর্চাটা খুবই জরুরী। বিশেষ করে প্রতিদিন সকালে রেওজটা করতে হবে। অন্তত ঘন্টাখানেক গলাকে নার্সিং করতে হবে। এখন তো প্রযুক্তির সময়, আগের মত হাতে বাজানো তানপুরাও প্রয়োজন হয় না, ডিজিটাল তানপুরা আছে। আজকাল ফোনেও তানপুরা আছে। তানপুরা ছেড়ে দিলে বাজতে থাকবে। সাথে সাথে গুন গুন করে গেয়ে নিলেই হয়। এটাও এক ধরণের চর্চা। কাজেই ইচ্ছে করে অনন্ত এক ঘন্টা চর্চা করা উচিত। সারগাম না করে যদি পাঁচ/দশটা গানও গুন গুন করে গাওয়া যায় তাও একটা বড় রেওয়াজ হবে।’
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেও অধিক সময় গানের সঙ্গে বসবাস সুবীর নন্দীর। তারপরও নিজেকে তিনি নবীনই মনে করেন। তার ভাষায়- ‘আমার কাছে মনে হয়, গান মাত্র শুরু করেছি। সঙ্গীত এমন একটি জিনিস যে- এর কোন কুল কিনারা নেই। যতই গাইবেন ততই সমৃদ্ধ হবেন। পঞ্চশ বছর ধরে গান গাওয়া খুব একটা আত্মতৃপ্তির বিষয় না, ভালো গান গাওয়া একটি বড় জিনিস। যদি আমি মনে করি যে আমার সব হয়ে গেছে, আমি অনেক বড় কিছু হয়ে গেছি তাহলে আর হবে না। গান সেখানেই থমকে যাবে। প্রতিদিন নিজেকে নতুন করে আরও তৈরি করতে হবে।’
গানের শুরুর দিকটার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পারিবারিক ভাবেই আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা। মা আমার প্রথম গুরু। তার কাছ থেকেই আমি গান শিখেছি। এরপর শ্রদ্ধেয় তপন নন্দি, বাবর আলী খান সাহেব ছিলেন। এরপর প্রতিদিনই শেখার উপর আছি। শুরুটা আমাদের বেতার থেকেই। সেই সময় বড় বড় মিউজিক ডিরেক্টরের গান করেছি। তাদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছি। কি করে গাইতে হয়? কি করে সুরটা লাগাতে হয়?’
নতুনদের নিয়ে এই গুনি শিল্প বলেছিলেন, ‘আমাদের নতুনদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। তারা অনেক ভালো করছে। অনেকের সুরে চিন্তা ও দরদ আছে। আমি বেশ উপভোগ করি। আমি মনে করি নতুন, পুরাতন, মধ্যম সবার মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে। তবেই নতুনত্ব সৃষ্টি হবে। অনেকেই আমার সঙ্গে গানের আগ্রহ প্রকাশ করে আমি সবাইকে স্বাগত জানাই। আমি চাই, নতুনরা আমাদের সঙ্গে থেকে- আমরা যা অর্জন করেছি, আমরা যাদের থেকে গানের তালিম নিয়েছি, তারা আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তা তারাও জানুক। নতুনদের দূরে রাখা উচিত নয়, তাদের কাছে টেনে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিলে আরও ভালো কিছু হবে।’
যা হোক; আজ ৭ মে সকালে প্রিয় সুবীর দা’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। কথা ছিল তার বাড়িতে যাবো। কিন্তু ‘দিন যায় কথা থাকে’। সেদিন অনেক কথা হয়েছিল কিন্তু এখনও অনেক কথা রয়েছে বাকি। জীবনের সব গল্প আর শোনা হলো না।
প্রিয় সুবীর দা, বাংলাদেশে সুরের ঐশ্বর্য্য নিয়ে আপনি ঘুমিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু আমরা বলবো- ‘কীর্তিমানের মৃত্যু হয় না’। আপনি সারাজীবন বেঁচে থাকবেন আপনারই স্বর্গীয় সুরের ধারায়! বিনম্র শ্রদ্ধা!
এসএ/