স্রষ্টার সন্তুষ্টি পাবেন যে কর্মে
প্রকাশিত : ১৯:১৪, ৩১ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ২০:৩৩, ৩১ জানুয়ারি ২০২০
স্রষ্টা প্রার্থনা পছন্দ করেন এবং অবিচল বিশ্বাস নিয়ে সেই প্রার্থনা করলে, সেইসাথে প্রার্থনা পূরণের জন্যে নিরলস পরিশ্রম করলে তা কবুলও করেন তিনি। শুধু অনুভব করতে হবে যে, সর্বশক্তিমান প্রভুর সামনে নতজানু হয়ে/ সেজদায় পড়ে আছি আমরা। তিনি আমাদেরকে দেখছেন, আমাদের সব কথা শুনছেন। আমাদের প্রার্থনা কবুল হয়ে গেছে। এই অনুভূতি যখন আমাদের মনে সৃষ্টি হয়, তখন পাওয়ার আর কিছু বাকি থাকে না।
আকাঙ্ক্ষা বা চাওয়া নিবিষ্ট হলে এবং তাতে শতভাগ আন্তরিকতা থাকলে পরম করুণাময় কীভাবে তা পূরণ করেন, নিজের জীবন থেকে তার একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত আমাদেরকে শোনান বিশিষ্ট লেখক বিশু চৌধুরী। তার পুরো নাম ড. মো. সাহাদ চৌধুরী। পেশাজীবনে তিনি ছিলেন কন্ট্রোলার জেনারেল অব একাউন্টস।
এক আলোচনায় তিনি বলেন, সেবার রোমে গেছি। ভিসুভিয়াস দেখতে যাব। শৈশব থেকে এত পড়েছি ও শুনেছি ইতালির ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির কথা। নির্ধারিত দিনে ভিসুভিয়াস পাহাড়ের নিচে সমবেত হলাম আমরা তিন সহকর্মী। চূড়া পর্যন্ত মোট উচ্চতা ১২৮০ মিটার, এর মধ্যে ৬০০ মিটার পর্যন্ত গাড়িতে ওঠা যায়। বাকিটা উঠতে হবে হেঁটে। দিনটা ছিল বৃষ্টি আচ্ছন্ন, মেঘলা। সহকর্মী দুজন বয়সে তরুণ, ওরা তরতর করে উঠে যাচ্ছিল। আমি ধীরে ধীরে উঠছি। বার বার পিছিয়ে পড়ছি। আমার কষ্ট বুঝতে পেরে ওরা বলল, স্যার, আপনি না-হয় এখানেই থাকুন। বিশ্রাম নিন। আমরা চূড়াটা ছুঁয়েই খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব। আমি বললাম, শোনো, আমার একটি লক্ষ্য আছে। আমি ভিসুভিয়াসের চূড়ায় উঠব এবং সোচ্চারে ঘোষণা করব-সমস্ত প্রশংসা তাঁর!
ওরা আর কিছু বলল না। কিন্তু খানিকটা যাওয়ার পর অবস্থা এমন হলো যে, আমার সারা শরীরে ব্যথা। আমার হার্টও তখন ছিল বেশ দুর্বল। সবমিলিয়ে আর নড়তেই পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল একটা বাঁশের লাঠি যদি কোনোক্রমে পেতাম এখন, তাতে অন্তত ভর দিয়ে ওঠা যেত। কিন্তু তা কী হয়? এখানে কোথায় পাব তেমন লাঠি? একটু জিরিয়ে নেয়ার ফাঁকে বসে বসে এসব ভাবছি, হঠাৎ দেখি সহকর্মীদের একজন ওপর থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে, তার হাতে আমার বুক-সমান একটা বাঁশের লাঠি! কাছে এসে সে বিনয়ের সাথে বলল, স্যার, এটা কি আপনি ব্যবহার করবেন? পাহাড়ে উঠতে কিছুটা সুবিধে হবে। আমি বিস্মিত! এমনটাও ঘটে? অতঃপর সেই পড়ন্ত বেলায় মেঘে ভিজতে ভিজতে লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে আমি ভিসুভিয়াসের চূড়ায় পৌঁছলাম। বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখলাম চারপাশ। ভাবছিলাম এ কী করুণা তাঁর! আমার সমস্ত চেতনা দিয়ে বললাম, প্রভু, সমস্ত প্রশংসা তোমার। এ অবস্থানে এ উচ্চতায় আমাকে আসার সুযোগ ও সামর্থ্য দেয়ার জন্যে তুমি আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করো।
আসলে কাতর হৃদয়ে মানুষের একান্ত চাওয়াতে স্রষ্টা এভাবেই সাড়া দেন। এজন্যে আমাদের প্রত্যেককেই একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। সেই লক্ষ্য যেন অর্জন করতে পারি, সেজন্যে হৃদয় নিংড়ানো আকুতি নিয়ে প্রভুকে বলতে হবে। প্রভুকে বলার সময় ভুলে যেতে হবে আর সবকিছু। দিনের কিছু সময় এইভাবে প্রার্থনার জন্যে নির্দিষ্ট করে ফেলতে হবে। আমাদের মধ্যে যখন এরকম শুদ্ধ চাওয়া সৃষ্টি হবে, যদি সত্যিই এর মধ্যে কল্যাণ থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই পূর্ণতা দেবেন পরম প্রভু-এ বিশ্বাস নিয়ে বলতে হবে। তবে এখানে একটি বিষয় আছে। তিনি জানেন কীসে আমাদের কল্যাণ আর কীসে আমাদের অকল্যাণ। সেজন্যেই তো সূরা বনী ইসরাইলের ৮০ নম্বর আয়াতে প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে, আমার প্রতিপালক। তুমি আমাকে যেখানেই নাও সত্য ও কল্যাণের সাথে নাও। আর যেখান থেকেই ফিরিয়ে নাও, সত্য ও কল্যাণের সাথে ফিরিয়ে নাও। তোমার কুদরতি শক্তি দিয়ে আমাকে সাহায্য করো। যে জন্যে আমরা প্রার্থনা করছি, তাতে আমাদের কল্যাণ থাকলে প্রভু নিশ্চয়ই তা আমাদের জন্যে কবুল করবেন এবং তা না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।
একজন সাধক তার শিক্ষাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ছোট ছোট চাওয়া আল্লাহ পূরণ করেন কিন্তু বড় বড় প্রার্থনা তিনি কেন কবুল করেন না? এর উত্তরে শিক্ষক বলেছিলেন, বড় প্রার্থনা করার জন্যে তো বড় সময় দিতে হবে। বড় প্রার্থনার জন্যে তো ছোট সময় দিলে হবে না। এই যে অপেক্ষা করা, বড় চাওয়ার জন্যে বড় সময় লাগে, বড় অপেক্ষা লাগে, বড় ধৈর্য লাগে। ধৈর্যটা হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বড় চাওয়া আল্লাহতায়ালা দেন, কিন্তু আপনাকে তো সে চাওয়াটা গ্রহণ করার মতো বড় হতে হবে।
আল্লাহতায়ালা আসলে খুব রহম দিল। ধরুন একটা পিঁপড়া সবসময় মিষ্টি তো একটুকরা চায় না। সে চায় কিন্তু একটা পানতোয়া। একটা পানতোয়া যদি পিঁপড়াকে দিয়ে দেয়া হয় পিঁপড়া কী করবে? হয় পানতোয়ার চাপে সে শেষ, অথবা পানতোয়ার ওপরে রসে ভিজে শেষ। পানতোয়া মানে রসের বড় গোল্লা। এবং কোথাও কোথাও নাকি এক কেজি সমান রসের গোল্লা পাওয়া যায়। এক কেজি ছানা। বিশাল রসগোল্লা, রসে চকচক করছে। পিঁপড়া কী করবে? নিচে পড়লেও শেষ, ওপরে উঠলেও রসে ভিজে শেষ। এজন্যে ধৈর্যের সাথে নিরলস পরিশ্রমটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে তৈরি হওয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন তৈরি হবো, আমরা অবশ্যই পাবো।
তাই আমরা একাগ্রতা নিয়ে প্রার্থনা যেমন করব, তেমনি তা পূরণের জন্যে লেগেও থাকব, কাজও করব। সেইসাথে অন্যের জন্যেও প্রার্থনা করব। ১৯৮৮ সালে সান ফ্রান্সিসকো জেনারেল হসপিটালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ১০ মাস ধরে ভর্তি আছেন এমন ৩৯৩ জন হৃদরোগীকে নিয়ে একটি গবেষণা চালান ডা. রানডল্ফ বায়ার্ড। দৈব-চয়নের মাধ্যমে রোগীদেরকে দুটো গ্রুপে ভাগ করে এক গ্রুপের জন্যে নিয়মিত প্রার্থনা করতে বলা হলো দেশজুড়ে নিয়োজিত প্রার্থনাকারীদের। আরেক গ্রুপের জন্যে চলল শুধু প্রচলিত চিকিৎসা। দুই গ্রুপের কাউকে এমনকি ডাক্তারদেরও এ বিষয়ে কিছুই বলা হলো না। বিস্ময়করভাবে দেখা গেল, যে গ্রুপের জন্যে প্রার্থনা করা হয়েছে অন্য গ্রুপের চেয়ে আগে তারা হাসপাতাল ছেড়েছেন, তাদের এন্টিবায়োটিক লেগেছে মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এবং তারা পরবর্তী জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ ক্ষেত্রে।
সবসময় সবার জন্যে দোয়া করব। খাবার গ্রহণের শুরুতে ও শেষে যারা এই প্রস্তুতের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন, চাষী থেকে রাঁধুনি সবার জন্যে দোয়া করব। সেই রিকশাচালকের কথা মনে পড়ল, যার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম দশ বছর আগে। তার জন্যে দোয়া করব। এই দোয়ার ফলে আমরা দায় থেকে মুক্ত জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। আর যেহেতু আমরা অন্যের ভালোর জন্যে কাজ করছি, প্রাকৃতিক নিয়মেই আমরা ভালো থাকব। আমাদের অন্তরে প্রশান্তি আসবে।
কীভাবে আমরা ভালো থাকব? একটু অন্যভাবে আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করতে পারি। আমরা জানি আমাদের মস্তিষ্ক একইসাথে চিন্তার ট্রান্সমিটার ও রিসিভার। আমরা যদি অন্য কাউকে বদদোয়া দেই বা অকল্যাণ কামনা করি, আমাদের ব্রেন নিজেও সেটা রিসিভ করে। যদি মিস্টার এক্স-এর জন্যে গর্ত খুঁড়ে কামনা করি-মিস্টার এক্স গর্তে পরুক, মিস্টার এক্স গর্তে পরুক। আমাদের ব্রেন ভাববে শুধু মিস্টার এক্স কেন? হোয়াই নট মি? আমি নই কেন! ব্রেন আমাদের গর্তে ফেলার ব্যবস্থা করে দেবে। বিপরীতভাবে আমরা যখন অন্যের জন্যে দোয়া করব, অন্যের কল্যাণ কামনা করব। আমাদের ব্রেনও কিন্তু সেটা রিসিভ করবে এবং যাতে আমাদের ভালো হবে, ব্রেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সেই পথে পরিচালিত করবে।
আসলে আমরা যত অন্যের ভালো চাইব, আমরা নিজেরাই তত উপকৃত হবো। তত আমরা প্রশান্তি পাবো। আমরা জানি, মনে প্রশান্তির পথে সবচেয়ে বড় শত্রু আত্মবিনাশী প্রোগ্রাম-রাগ, ক্ষোভ, ঈর্ষা, হিংসা ইত্যাদি। এখন কেউ যদি আপনার সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ ব্যবহার করে, আপনাকে কষ্ট দেয়, অপমান করে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার মাঝে রাগ-ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। আবার ঈর্ষা-হিংসাও মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। নিজের ছেলে/ মেয়ে এ প্লাস না পেলে আমাদের খারাপ লাগে, কিন্তু এই খারাপ লাগা বহুগুণ বেড়ে যায় যখন শুনি প্রতিবেশীর ছেলে/ মেয়ে ঠিকই এ প্লাস পেয়েছে। আমরা হয়তো সচেতনভাবে ঈর্ষামুক্ত থাকতে চাই, কিন্তু তারপরও আমরা দেখি কারো কারো আনন্দের সংবাদে আমরা সেই অর্থে খুশি হতে পারি না। বাইরে খুশির ভান করি কিন্তু বুকে ঠিকই একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করি। কারণ যা-ই হোক না কেন, দোষ যারই হোক না কেন এই দুঃখ, কষ্ট, ঈর্ষা, হিংসা শেষ পর্যন্ত আমাদের নিজেরই ক্ষতির কারণ হয়। আমাদের প্রশান্তি নষ্টের কারণ হয়। এগুলো থেকে মুক্তির অন্যতম মাধ্যম হতে পারে তাদের জন্যে দোয়া। হয়তো কেউ আপনাকে কষ্ট দিয়েছে, আপনি তার জন্যে দোয়া করুন যেন তিনি ভালো মানুষ হতে পারেন। কারো খুশির সংবাদে আপনার মনে ঈর্ষার সৃষ্টি হয়েছে? আপনি সাথে সাথে তার জন্যে দোয়া করুন। আন্তরিকভাবে দোয়া করুন, দেখবেন আপনার কষ্ট লাগা দূর হয়ে গেছে। আপনার মাঝে প্রশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তাই কাউকে ভালো লাগলে তার জন্যে দোয়া করব, কাউকে ভালো না লাগলে তার জন্যে আরো বেশি করে দোয়া করব। কাউকে আনন্দে দেখলে তার জন্যে দোয়া করব, আর কাউকে কষ্টে দেখলে তার জন্যে তো অবশ্যই দোয়া করব। দিনের যে-কোনো সময় আমরা দোয়া করতে পারি। নামাজের পরে কিংবা যার যার ধর্মবিশ্বাস অনুসারে প্রার্থনা শেষে তাদের কল্যাণ কামনা করতে পারি।
আসলে ব্যক্তিগত দোয়ার মাধ্যমে হোক বা সংঘবদ্ধ দোয়ায় নাম দেয়ার মাধ্যমে হোক, আমরা প্রার্থনার মাধ্যমে প্রভুর কাছে মূলত আশ্রয় প্রার্থনাই করি। এবং এই আকুতি মানুষের আজন্ম।
আরকে//