হযরত শাহপরাণ (রহ.)র ধর্ম প্রচার
প্রকাশিত : ১১:১৫, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯
যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের মহিমায় পাক-ভারত-বাংলাদেশ তথা সিলেটের আনাচে-কানাচে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে তাদের মধ্যে হযরত শাহপরাণ (রহ.) ছিলেন অন্যতম। বিশ্ব বরেণ্য ওলী হযরত শাহজালাল (রহ.)’র পরেই তার খ্যাতি। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করে খাদেমনগরের টিলায় চির নিদ্রায় শায়িত হন শাহপরাণ (রহ.)।
সিলেট বিজয়ের পর তরফ, ইটা, লংগা, জৈন্তা, বুন্দিশাল সহ বিভিন্ন স্থানে তিনি ধর্ম প্রচার করেন। তাই দেখা যায়, সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব এলাকাতেই তিনি দাওয়াতের কাজ করেছেন। সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিমনগর এলাকায় টিলার উপর একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের নিচে রয়েছে শাহ পরাণের কবর। মাজারের পশ্চিম দিকে মোগল বাদশাদের স্থাপত্বকীর্তিতে নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে।
মহান দরবেশ হযরত শাহপরাণ (রহ.)র ছিলেন হযরত শাহজালাল (রহ.)’র ভাগ্নে। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ বোখারার অধিবাসী। হযরত শাহপরাণ (রহ.)র ঊর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ জালাল উদ্দিন (রহ.) বোখারা হতে এসে প্রথমে সমরকন্দে এবং পরবর্তীতে তুর্কীস্থানে বসবাস করেন। হযরত শাহপরাণ (রহ.)’র পিতা একজন শীর্ষ স্থানীয় আলেম ও খুব উচুঁ স্তরের বুজর্গ ছিলেন। সে সময় তদাঞ্চলে তার মত কামেল বুজর্গ ব্যক্তি খুব কমই ছিলেন।
তাঁর মাতাও ছিলেন একজন ধর্ম পরায়না নেককার মহিলা। তাঁর গুণের অভাব ছিল না। অতি উন্নত চরিত্রের অধিকারিণী ছিলেন তিনি। হযরত শাহ পরাণের জীবনে সিদ্ধি লাভের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের অবিরাম সাধনা, সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। ঠিক তেমনিভাবে মহীয়সী মাতার পবিত্র চরিত্র এবং নেক জীবন পুত্রের জীবনে সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার পেছনে সুদূর প্রসারী ভূমিকা রেখেছে।
হযরত শাহপরাণ (রহ.) শৈশব ও কৈশোর অবস্থায় নিজ মাতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। অত:পর উচ্চতর শিক্ষা লাভ করার উদ্দেশ্যে অন্যান্য শিক্ষকের শরণাপন্ন হন। ইস্পাহানের সুবিখ্যাত আলেম ও খ্যাতনামা বুজর্গ হযরত কামালুদ্দিন (রহ.) অন্যতম প্রধান ওস্তাদ ছিলেন। তিনি তাঁর নিকট থেকে এলমে তাফসীর, হাদীস, ফিক্হা, মানতেক প্রভৃতি শিক্ষা লাভ করেন। শোনা যায়, শাহপরাণ (রহ.)র জন্মগ্রহণ কালে তাঁর মাতার পার্শ্বে অবস্থানরত পরিচর্যাকারিণী মহিলারা সদ্য প্রসূত সন্তানের মুখে আল্লাহ আল্লাহ যিকিরের শব্দ শুনেছিলেন।
কামালিয়াত হাসিলের পর তিনি ‘মুরাকাবা’ ‘মুশাহাদার’ মাধ্যমে তদীয় মামা ও মুর্শিদ হযরত শাহজালাল (রহ.)র সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগাযোগ রাখতেন। হযরত শাহপরাণ (রহ.)র মুর্শিদ ও মামা হযরত শাহজালাল (রহ.)’র বদৌলতেই তিনি কামালিয়াত হাসিল করেন এবং তাঁর আদেশেই তিনি সিলেট শহর থেকে প্রায় ৫/৬ মাইল পূর্বে অবস্থিত দক্ষিণ গাছ পরগণায় (খাদিমনগর) যেয়ে আস্তানা স্থাপন করেন এবং ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত থাকেন। অদ্যাবধি সে স্থানটি শাহপরাণ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে আছে।
অতি সাধারণ জীবন যাপন করেও ঈমানের পূর্ণতা এবং আমলের নিষ্ঠার বদৌলতেই খোদায়ী নূর লাভ করে ধন্য হয়েছেন শাহপরাণ (রহ.)। তাঁর কঠোর সাধনার ফলে এমন সব অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হন, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনো ক্রমেই সম্ভবপর নয়। এমনকি স্বচক্ষে না দেখলেও সে সব আশ্চর্য ঘটনার কথা অনেক সময়ে অনেকের পক্ষে বিশ্বাস করাও কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু আউলিয়াদের কারামত যে ধ্রব সত্য তৎবিষয়ে কারোর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। ‘আকায়িদে নছফিয়া’ কিতাবে উল্লেখ আছে, তাঁদের কোনো বাসনা বা প্রার্থনা আল্লাহ তা’য়ালা অপূর্ণ রাখেন না। সে জন্য তাঁদের মুখে এমন বরকত প্রদান করেন যে, তাঁরা মুখ দিয়ে যা বলেন বা অন্তরে বাসনা করেন, আল্লাহ তা’য়ালা তাই বাস্তবে পরিণত করে দেন।
হযরত শাহপরাণ (রহ.) এর বহু অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তা হতে দুটি এখানে উল্লেখ করা হলো: এক. হযরত শাহপরাণ (রহ.) এর মাত্র পাঁচ কি ছয় বছর বয়সের সময়ের একটি ঘটনা। একদা তিনি স্বীয় পিতার নিকট বসে পাক কালামে মজিদ তিলাওয়াত করছিলেন। এমন সময় একটি লোক এসে বলল, হুজুর আমার একটি দুর্ঘটনার খবর শুনুন। আমার একমাত্র ছেলেকে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে। তারপর আজ তিন মাস অতীত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার খোঁজ খবর নেই। কোথাও তার সন্ধান পাচ্ছি না। দেখতেই পাচ্ছেন আমি বৃদ্ধ মানুষ। সুতরাং আমি আমার চোখেরমণি পুত্রটিকে হারিয়ে চারিদিক একেবারে অন্ধকার দেখছি। আমার স্ত্রী কলিজার টুকরা পুত্রটিকে হারাইয়া দিবা নিশি কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনুগ্রহপূর্বক আপনি আমার ছেলেটির জন্য দোয়া করুন, সে যেন আমাদের কোলে ফিরে আসে।
হযরত শাহপরাণ (রহ.) এর পিতা কিছু বলবার পূর্বেই হযরত শাহপরাণ (রহ.) বলে উঠলেন- যাও তোমার কোনো চিন্তা নেই, নিশ্চিন্ত মনে তুমি গৃহে প্রত্যাবর্তন কর এবং তথায় গিয়ে তুমি তাকে খানাপিনা খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর। মাগরিবের নামাযের পূর্বেই তোমার ছেলে ইনশাআল্লাহ বাড়ি ফিরে আসবে। আল্লাহ তা’ওয়ালার কাছে সবই সম্ভব। তাঁর কুদরত কে বুঝিতে পারে?
বালক হযরত শাহপরাণ (রহ.)র এই কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা তার বুজুর্গ পিতাকেও বিস্মিত করে তুলল। তিনি পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা শাহপরাণ, তুমি এই ব্যাপারে এত নিশ্চিত হলে কী করে? হযরত শাহপরাণ (রহ.) তাঁর পিতাকে পবিত্র কুরআন শরীফে বর্ণিত হযরত খিযির (আ.) ও হযরত মুসা (আ.) এর ঘটনা উল্লেখ করে বললেন, পরম করুণাময় আল্লাহ তা’য়ালা যাকে ইচ্ছা করেন, তাকেই তাঁর অগাধ জ্ঞান ভান্ডার হতে জ্ঞান দান করে থাকেন। উল্লেখিত লোকটিকে হযরত শাহপরাণ যা বলেছিলেন, তা সম্পূর্ণ সত্যে পরিণত হয়েছিল। উক্ত বৃদ্ধের সেই হারানো ছেলেটি মাগরিবের ওয়াক্তের পূর্বেই বাড়ি ফিরে এসেছিল।
অপর ঘটনাটি হলো- হযরত শাহজালাল (রহ.) সিলেট আসার পথে হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহঃ)র সম্মানিত মেহমান হিসেবে কয়েকদিন দিল্লীতে অবস্থান করেন। দিল্লী থেকে আসার সময় হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া তাঁকে একজোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। সিলেটে আসার পর কবুতর দুটোর বংশ বৃদ্ধি পায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রান্ত হবার পর আজও অনেক মানুষ হযরত শাহজালাল (রহঃ) ’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই জালালী কবুতরগুলো খায় না কিংবা বধও করে না।
সাধারণ মানুষ এমন কি হযরত শাহজালালের সহচর কেউই যখন জালালী কবুতর বধ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না, তখন হযরত শাহপরাণ (রহঃ) প্রতিদিন একটি করে কবুতর জবাই করে খাওয়া শুরু করেন এবং কবুতরের পালকগুলো তিনি সযত্নে রেখে দিতেন। এমনিভাবে প্রতিদিন কবুতর খাওয়ার ফলে কবুতরের সংখ্যা কিছু হ্রাস পেলো।
একদিন কবুতরের উপর খেয়াল হলো হযরত শাহজালাল (রহ.)র। খাদেমগণকে তিনি এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা আসল ঘটনা খুলে বললো। হুকুম হলো শাহপরাণ (রহ.)কে ডেকে আনার। হযরত শাহপরাণ (রহ.) তখন মোরাকাবায় ছিলেন। তাঁকে তলবের কারণ জানতে পেরে বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করুন, আমি কবুতরগুলো ফেরত দিচ্ছি।’ এই বলে তিনি হুজরার পার্শ্বে রক্ষিত পালকগুলো হাতে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন- যাও আল্লাহর হুকুমে তোমরা হযরত শাহজালাল (রহ.)র দরবারে উড়ে যাও। সঙ্গে সঙ্গে কবুতরগুলো জিন্দা হয়ে উড়ে গেল।
ভাগ্নের এহেন কারামতি দেখে মামা ও মুর্শিদ হযরত শাহজালাল (রহ.) অত্যন্ত খুশী হলেন। তাঁকে দূরে কোথাও আস্তানা স্থাপন করতে নির্দেশ দিলেন। মামার আদেশ অনুসারে তিনি খাদিমপাড়া চলে যান এবং সেখানে তাঁর সাধনা ক্ষেত্র ও ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন।
আজও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে অসংখ্য লোক প্রতিদিন হযরত শাহজালাল (রহ.)’র পবিত্র মাজার জিয়ারত করার পর হযরত শাহপরাণ (রহ.)’র মাজার জিয়ারত করতে যান। এমন কি রাষ্ট্র প্রধান, সরকার প্রধান, মন্ত্রী, এমপিগণও তাদের নির্বাচনী কাজ সেখান থেকে শুরু করেন। রাত-দিন কুরআন তেলাওয়াত, জিয়ারত, মিলাদ মাহফিল, দোয়া-দুরুদ, যিকির-আযকার এবং ফাতেহা পাঠ করা হয় শাহপরাণ (রহ.)’র মাজারে বসে।
এএইচ/