ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

হরিজনপট্টিতে আলো ছড়াচ্ছে ‘রাজধানী আদর্শ বিদ্যাপীঠ’

প্রকাশিত : ১৯:১৬, ৭ অক্টোবর ২০১৭ | আপডেট: ১৫:৪০, ৮ অক্টোবর ২০১৭

মেথর, হরিজন, দলিত যে নামেই ডাকুন না কেন, তারা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণীগুলোর একটি। শিক্ষা সংস্কৃতি সবক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে। সমাজের মূল ধারার সঙ্গে যুগ যুগ ধরে তাদের এই ফারাক। মূলধারার সভ্য দাবিদার লোকজন কখনই হরিজনদের মর্যাদা দিতে চাননি। রাজধানীর টিকাটুলী মেথরপট্টিও এর ব্যাতিক্রম নয়। অবহেলা বৈষম্যের মধ্যেই তাদের নিত্য পথচলা।

তবে দীর্ঘদিনের এই বৈষম্য ও অবহেলা ঘোচাতে চান হরিজনরা। তারা আর পিছিয়ে থাকতে চান না। হরিজনরা চান না তাদের সন্তানরাও তাদের মত অযন্ত অবহেলায় অবজ্ঞায় জীবন কাটিয়ে দিক। হরিজনদের স্বপ্নসারথি রাজধানী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুলটিই তাদের সচেতন করেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে ভালোভাবে বাঁচার, জীবনমান উন্নয়নের। সমাজের অবহেলিত এই মানুষগুলোকে মূল স্রোতে নিয়ে আসার জন্য কাজ করে যাচ্ছে এই বিদ্যাপীঠ।

টিকাটুলী মেথরপট্টির ‘রাজধানী আদর্শ বিদ্যাপীঠ’র প্রতিষ্ঠা ১৯৮২ সালে। ফুড ফর দি হাঙ্গরী ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সংস্থা স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষার বিস্তারে অনন্য ভূমিকা রেখে আসছে। এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক এস এম শাহ আলম বলেন, হিন্দি এবং তেলেগু ভাষাভাষি দুই শ্রেণির মানুষ এখানকার সুইপার কলোনিতে বসবাস করেন। তাদের জন্য এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য ছিল এই জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা। যাতে তারা মৌলিক অধিকারগুলো সম্পর্কে সচেতন হোন, জীবনমান উন্নত হয়। প্রথম দিকে এখানকার লোকজন পড়ালেখার প্রতি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তারা স্কুলে সন্তানদের পাঠাতে আগ্রহ দেখাতেন না। কিন্তু ফুড ফর দি হাঙ্গরী ইন্টারন্যাশনালের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে পড়ালেখার তাগিদ জন্ম দেন।  ফলে হরিজনরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে থাকে।

জানা গেছে, দীর্ঘ সময় ফুড ফর দি হাঙ্গরী ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটি পরিচালনা করে আসলেও ২০১৩ সালে তারা স্কুলটির দায়িত্ব থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। তারা মেথরপট্টির কমিউনিটির কাছে স্কুলটি বুঝিয়ে দেয়। কমিউনিটির কমিটি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল পরিচালনা করে। পরে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এর কাছে হস্তান্তর করে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ৫ম শ্রেণি থেকে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলের পাঠদানে উন্নীত করে। 

সরেজমিন স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে, তিনতলা বিশিষ্ট স্কুলের দেয়ালের চুন সুরকি খসে পড়ছে। ভবন অনেক পুরাতন হওয়ায় এর রং নষ্ট হয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। জীর্নশীর্ণ ভবনে চুইয়ে পড়ছে জ্ঞানের আলো। শ্রেণিকক্ষে খুশিমনে পাঠদান করাচ্ছেন স্কুলের শিক্ষিকা বিথী রাণী। বিথী রাণী জানান, এখানকার ছেলে-মেয়েরা খুবই ট্যালেন্ট। তবে তারা বাংলায় খুব একটা অভ্যস্ত নয়। কারণ ছোট বেলা থেকেই হিন্দি ও তেলেগু ভাষায় কথা বলতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বিথী রাণী বলেন, শিশু শ্রেণি থেকেই আমরা তাদেরকে বাংলা শেখানোর চেষ্টা করি। খুব দ্রুতই তারা লিখতে ও বলতে পারে। তাদের পড়াতে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি বেশ আগ্রহ আছে। 

মোহন সামুন নামে একজন এই স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। গ্র্যাজুয়েশন শেষে বর্তমানে এখানেই পাঠদান করাছেন। তিনি বলেন, এই স্কুলে চাকরি করতে আমার অনেক ভাল লাগছে। কারণ এরা সবাই আমার আপন ভাই-বোনের মত। এই স্কুল থেকে আমিসহ আমার সাত ভাই বোন লেখাপড়া করে বড় হয়েছি। আমরা অনেক গরিব। আমার বাবা মা মেথরের কাজ করতেন। তারা অনেক কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন। আমার দুই ভাই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চাকরি করেন। আমি এখানে শিক্ষকতা করছি। বাকিরা ভালো জায়গায় কাজ করছেন। তারা সবাই এই স্কুলে পড়ালেখা করেছেন।

শিক্ষক মোহন বলেন, এই স্কুল থেকে পাশ করে অনেকেই এখন ভালো চাকরি করছেন। মেথরপট্টিতে বেড়ে উঠেও এই স্কুলের কল্যাণে অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত। আগামীতে এ স্কুল থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এমন আশার কথা জানান মোহন সামুন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ‘রাজধানী আদর্শ বিদ্যাপীঠ’স্কুলে তিন শতাধিক ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তাদেরকে পাঠদানের জন্য রয়েছেন ১২ জন শিক্ষক। এক সময় ক্লাসে শিক্ষার্থী কম থাকলেও এখন প্রতিটি শ্রেণীকক্ষেই ভরপুর ছাত্র-ছাত্রী। সকাল ৭.৩০টায় ক্লাস শুরু হয়ে চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। শিক্ষকরা আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের পাঠদান করে যাচ্ছেন। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন ৭৫ থেকে ১২৫ টাকা পর্যন্ত। আবার কারো বেতন দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে মওকুফের ব্যবস্থাও রয়েছে। শিক্ষকদের বেতনসহ অন্যান্য খরচের বড় অংশই আসে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে।

এ বিষয়ে কোয়ন্টাম ফাউন্ডেশনের স্কুল প্রতিনিধি নিজাম হাসান সাদি বলেন, স্কুলটি পরিচালনার জন্য আমরা সব ধরণের অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি। শিক্ষকদের অর্ধেক বেতন এখন আমরা দিয়ে থাকি। এছাড়া স্কুলকেন্দ্রিক আরো কোন খরচ হলে সেটাও আমরা বহন করি। শিশুদের জন্য বিকেলের নাস্তার ব্যবস্থা করেছি। খেলাধুলাসহ ছেলে মেয়েদের নৈতিক মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশন। আমরা চাই এখানকার ছেলে মেয়েরা যেন শিক্ষীত হয়ে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হয়। 

স্কুল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কোমলমতি শিশু কিশোরদের চোখে মুখে খুশির আভা। তারা স্বপ্ন দেখছে উজ্জল আগামীর। স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সাবিতা রাণী বলেন, আমার আব্বু আম্মু আমাকে রোজ স্কুলে আসতে বলেন। স্কুলে আমার খুব ভাল লাগে। আমার সঙ্গে অনেকে এখন স্কুলে আসে। ভালভাবে পড়ালেখা করে আমি একজন বড় ডাক্তার হতে চাই।

স্কুলের ৫ম শ্রেণীর আরেক শিক্ষার্থী ত্রিনাথ দাস বলে, আমার মা বাবা অনেক কষ্ট করে, ঝাড়ুদারের কাজ করে আমাকে স্কুলে পাঠায়। আমি অনেক বড় হতে চাই। আমার মা বাবার ইচ্ছা আমি যেন শিক্ষিত হই।

রাজধানী আদর্শ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছরই সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো ফল করছে। সমাপনী পরীক্ষায় এখানকার শিক্ষার্থীরা শতভাগ পাশ করে থাকে বলে জানান প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, এ বছর আমাদের স্কুল থেকে ২২ জন শিক্ষার্থী সমাপনী পরিক্ষায় অংশ নেবে। আমরা সব সময় চেষ্টা করি তারা যেন রেজাল্ট ভাল করে। অতীতেও তারা ভাল রেজাল্ট করেছে। সামনেও করবে বলে আশা করি। তিনি বলেন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে স্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়নে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই পাশের মেথরপট্টিতে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের বসবাস। তারা এখানকার ছেলে মেয়েদের স্কুলমুখী করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। তাদেরকে নানাভাবে সহযোগিতাও করছে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখার মান উন্নয়নের জন্য প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮.৩০ পর্যন্ত কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় শিক্ষার্থীরা এখানে কোচিং করছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিকেলে নাস্তার ব্যবস্থাও করছে। 

কোয়ন্টাম ফাউন্ডেশনের স্কুল প্রতিনিধি নিজাম হাসান সাদি বলেন, আমরা স্কুলটির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই চেষ্টা করছি এর সামগ্রিক উন্নয়নের। বর্তমানে আমরা ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করেছি। ছেলে-মেয়েদের স্কুলমুখী করার জন্য ফাউন্ডেশন কাজ করছে। আমাদের ইচ্ছা আছে আগামীতে এই স্কুলকে কলেজে রুপান্তর করার। আমরা এ ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গেও কথা বলেছি। যেহেতু জমিটা তাদের। তারা আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছে। এখন আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি চরিত্র গঠনেও আমরা মনোনিবেশ করেছি। 

এক সময় এই সম্প্রদায়ের মা বাবারা তাদের সন্তানদের স্কুলে দিতে রাজি ছিল না। কচি বয়সেই বড়দেরমত তারা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কাজে লেগে যেতো। শিক্ষার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু সময় পাল্টেছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক এস এস শাহ আলম বলেন, অনেকে আগে স্কুলে সন্তানদের পাঠাতে হীনমন্যতায় ভুগতেন। এখন তাদের এ সমস্যাটা কেটে যাচ্ছে। বর্তমানে সুইপারের ছেলেও যে ভাল অফিসে চাকরি করতে পারে। এ বিশ্বাস তাদের মধ্যে জন্মেছে। ফলে তারা শিক্ষার প্রতি খুব আগ্রহী হয়ে ওঠেছে। আমি আশা করি আমাদের এই ছেলে-মেয়েরা আলোকিত সমাজ গড়তে ভূমিকা রাখবে। 

//এআর

 

  


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি