১ কিমিতে ৩ মাদরাসা
হাতিরঝিলে এতিমের নামে টাকা আদায় : বিব্রত পথচারী
প্রকাশিত : ১৮:৩৭, ১০ আগস্ট ২০১৭ | আপডেট: ১৩:৩৩, ১৩ আগস্ট ২০১৭
রাজধানীর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন স্থান হাতিরঝিল। যেখানে সপ্তাহের প্রতিদিন-ই যাতায়াত করেন লাখো মানুষ। কেউ পথচারী, কেউবা বিনোদনের আশায়। এসব আগন্তুকদের ঘিরে এই এলাকায় গড়ে উঠেছে এতিমের নামে টাকা আদায়কারী কয়েকটি চক্র। চক্রের উৎপাতে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন পথচারী ও বিনোদনপ্রেমিরা। বিরক্ত পথচারীদের কেউ কেউ এটিকে এতিমদের সাহায্যার্থে ভিক্ষাবৃত্তির নামে এক ধরনের ব্যবসা হিসেবে দেখছেন। কেউ সন্দেহ ভরা মনে এড়িয়ে চলছেন। কেউ আবার সাত-পাঁচ না ভেবেই সওয়াবের আশায় কিংবা সম্মান রক্ষায় দানও করছেন। তবে অভিযোগের সুরে অনেকেই বলছেন, রাস্তার মাঝে এভাবে টাকা আদায় বন্ধে সরকার বা প্রশাসনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা আজমত নিয়ামত কারওরান বাজারে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। হাতিরঝিল এফডিসি মোড়ে দেখা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, রোজ এখানে দেখি এতিমখানার নামে টাকা কালেকশন করা হয়। হাতিরঝিল এলাকার কয়েকটি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে এ কালেকশন করে তারা। কেউ কালেকশনের উদ্দেশ্য নিয়ে গভীরে গিয়ে কিছু জানতে চাইলে তাদের সঙ্গে অনেক সময় বাদানুবাদও লেগে যায়। তাদের একজনের সঙ্গে কারো বাদানুবাদ হলে সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা মৌচাকের মত ছুটে আসে। আজমত বলেন, আসলে তারা ভদ্রবেসে এক প্রকার চাঁদাবাজি করছে। এটা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাতিরঝিল সংলগ্ন বেগুনবাড়ী এলাকার মাত্র ১ কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে ৩টি মাদরাস ও এতিমখানা। এগুলোর মধ্যে হযরত পন্থীশাহ (র) কাসেমুল উলূম মাদ্রাসা ও এতিম খানা-২৯/এ দক্ষিণ বেগুনবাড়ী, খোজেস্তা আক্তার ইসলামিয়া নুরিয়া হাফেজিয়া মাদরাসা-২/১১ দক্ষিণ বেগুনবাড়ী ও আহসানুল উলূম মাদ্রাসা ও এতিম খানা-সিদ্দিক মাস্টারের ঢাল উত্তর বেগুনবাড়ীতে অবস্থিত। তিনটি প্রতিষ্ঠানের আয়ের প্রধান উৎস সাধারণ মানুষের দেয়া দান-খয়রাত। এতিমখানা কাম মাদরাসা নামে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ যোগাতে ভরসা করতে হয় দানের ওপর। নির্দিষ্ট কিছু জায়গা থেকে তাদের দান আসলেও মূল ভরসা সাধারণ মানুষ। আর এ সাধারণ মানুষের মধ্যে হাতিরঝিল এলাকায় আগতদেরকে-ই আদায়কারীরা প্রধান দাতা হিসেবে বেঁছে নিয়েছে। এভাবে টাকা আদায় করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই প্রশাসন থেকে অনুমোদন নেই। তারা যখন তখন পথচারীদের কাছে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতিম শিশুদের একবেলা খাওয়ানোর কথা বলে দান চায়। পথচারীরা দিতে না চাইলেও বারবার হাত বাড়ায়। তাদের এমন কার্যকলাপ পথচারীদের বিড়ম্বনা বাড়িয়ে তুলছে কয়েকগুন। এমনকি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর তুলনায় আদায়কারীর সংখ্যা বেশি। তাদের মাসিক ভিত্তিতে টাকা দেওয়া হয়। তারা দিনভর দান সংগ্রহ করে সন্ধ্যায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে জমা দেয়।
শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হচ্ছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোতে এতিম ও অস্বচ্ছল পরিবারের ছেলেদের ইসলামী ও কুরআন শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি খাবার ও থাকার ব্যবস্থাও আছে। তবে এসবের খরচ মেটাতে তাদের আলাদা আদায়কারী নিয়োগ দেয়া আছে।
জানতে চাইলে আহসানুল উলূম মাদ্রাসা ও এতিম খানার কয়েকজন শিক্ষক জানান, এতিম খানাটিতে ২টি বিভাগ আছে। একটি হিফজ বিভাগ। অপরটি কুরআনিয়া বিভাগ। হিফজ বিভাগে ২৮ জন ছাত্র আছে। আর কুরআনিয়া বিভাগে ৪৬ জন ছাত্র আছে। যেখানে ৬ জন শিক্ষক তাদের পাঠ দান করেন। আর তাদের ভরন পোষনের খরচ যোগাতে আদায়কারী নিয়োগ দেয়া আছে ৪ জন। যারা সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত হাতিরঝিল রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে টাকা আদায় করেন। তাদেরকে যোগ্যতা অনুযায়ী মাসে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। আর শিক্ষকদের বেতন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
তিন কক্ষ বিশিষ্ট দু’তলার আহসানুল উলূম মাদ্রাসা ও এতিম খানা ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দেয়া জমিতে প্রতিষ্ঠিত। নিজস্ব ভবন হওয়ায় কোনো আবাসন খরচ বহন করতে হয় না প্রতিষ্ঠাটিকে। তবে শিক্ষক, ছাত্র ও স্টাফদের খাওয়া বাবদ লাখেরও বেশি টাকা গুণতে হয় প্রতিষ্ঠাটিকে। তিন বেলা খাবারের জন্য প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ কেজি চাল লাগে। শিক্ষক, ছাত্র ও স্টাফদের সব খরচ মিলে মাসে দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার খরচ হয়। যার পুরোটাই আসে মানুষের দেয়া দান থেকে। হাতিরঝিলের আগন্তুকদের কাছ থেকেই মূলত ওই দানের টাকা আসে।
প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হাফেজ ইয়াসিন আরাফাত বলেন, সারাদেশের এসব মাদরাসা বা ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের দানের ওপরেই চলে। আমাদেরটাও তেমন। তবে এ কথা সত্য যে, আমাদের কিছু আদায়কারী আছেন যারা হাতিরঝিলে টাকা আদায় করেন। তবে অন্যান্য এতিমখানার মতো আমরা হাতিরঝিলের আদায়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নই। আমাদের বড় হুজুর হাফেজ ফরহাদ হোসেনের অনেক পরিচিতি লোকজন আছেন। যারা এখানে দান করে থাকেন।
দানের জন্য পথচারী কিংবা আগন্তুকদের বিরক্ত করা হচ্ছে কি না-এ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ভাই আদায় করি ঠিক আছে। যার ভাল লাগে সে দিবে। এর জন্য তো জোরাজোরি করা হয় না। এছাড়া আমরা টাকা আদায় করে খুব আয়েশি জীবনযাপন করি তাও না। আমাদের নাশতায় সবজি বা আলু ভর্তার সঙ্গে ডাল থাকে। দুপুরে মাছ বা মাংসের সঙ্গে ডাল থাকে। রাতে সবজি আর ডাল থাকে। এটা তো মানুষের সাধারণ জীবন। আমরা মানুষের দেওয়া দানের টাকা অহেতুক ব্যয় করি না। এভাবে অনুদান তোলার ক্ষেত্রে প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষক বলেন, আমাদের আদায়কারীদের ছবি ও পরিচয় সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়া আছে। বিষয়টি প্রশাসন জানে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হযরত পন্থীশাহ (র) কাসেমুল উলূম মাদরাসা ও এতিমখানাতেও খাবারের মান একই ধরনের। খোজেস্তা আক্তার ইসলামিয়া নুরিয়া হাফেজিয়া মাদরাসায় মোট ২০ জন ছাত্র আছে। যাদের স্টাফসহ ৩৫ জনের খাবার আয়োজন করতে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিমাসে ৭ বস্তা চাল প্রয়োজন হয়। খাওয়া এবং গ্যাস বিলসহ আনুসঙ্গিগ খরচ বাবদ প্রতিষ্ঠানটির মাসিক ব্যয় হয় ৮০ হাজার টাকা।
এই রশিদ দিয়ে সড়কে দাঁড়িয়ে টাকা আদায় করেন প্রতিষ্ঠানটির বেতনভূক্ত আদায়কারীরা।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে- ২০ জন ছাত্রের এই প্রতিষ্ঠাটিতে আদায়ের জন্য ১২ জন লোক নিয়োগ করা আছে। যাদের বেতন ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্রতিষ্ঠানটি পাঠদানে নিয়োজিত আছে মাত্র ২ জন শিক্ষক। শিক্ষকদের একজনের বেতন ১২ হাজার টাকা, অন্যজনের ৮ হাজার টাকা।
আদায়কারীর বহর থেকে মাসে কী পরিমাণ আদায় হয় জানতে চাইলে মাদ্রাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. জামাল খাঁ সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, দেখেন যা আদায় হয়, খরচ শেষে তার থেকে কিছুই অবশিষ্ঠ থাকে না। এখানে আগে নেশা ও জুয়ার আড্ডা ছিল। আমি এটা বন্ধ করে ছাত্রদের ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। এটা তো ভাল তাই না? আদায়কারীদের যোগ্যতা অনুযায়ী দৈনিক ৪শ’ থেকে ৫ শ’ টাকা দেন বলে জানান তিনি।
দাতাদের কাছ থেকে বড় অংকের অনুদান ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া হয় এই রশিদ দিয়ে।
অন্যদিকে খোজেস্তা আক্তার ইসলামিয়া নূরিয়া হাফেজিয়া মাদরাসার শিক্ষক আবু জাফর জানান, মাদরাসাটিতে ৩৫ জন ছাত্র আছে। যারা আশে-পাশে নিজ নিজ বাড়ী থেকে খেয়ে আসে। এদের পাঠদানের জন্য দুজন শিক্ষক আছেন। ১৯৯১সাল থেকে আবু জাফর মাদরাসাটিতে আছেন। তার বেতন ৫ হাজার টাকা। মাদরাসার জন্য কোনো আদায়কারী নেই। সৈয়দ আজম নামে এক ব্যক্তি মাদ্রাসাটি পরিচালনা করেন। এর ব্যয়ভারও তার।
রাজধানীর মুগদার বাসিন্দা নাসিমা আক্তার বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। কারওরান বাজার থেকে সিএনজি করে বাসায় ফিরছিলেন বুধবার বিকাল ৪ টায়। রেল আসার সময় হওয়ায় কারওরান বাজার রেল ক্রিসিংয়ে আটকে যায় তাকে বহনকারী সিএনজি। একটু পরেই মাদরাসার নামে রশিদ হাতে তার সামনে চলে আসে মাথায় টুপি ও পাঞ্জাবি পরিহিত একজন বয়স্ক মানুষ। তিনি এতিমের জন্য নাসিমার কাছে সাহায্য চাইলেন। নাসিমা বলেন, চাচা সামলে যান। ওই লোকটি ফের হাত বাড়িয়ে দেন। বলেন, মা এ দান বিফলে যাবে না, আখিরাতের জন্য জমা থাকবে। নাসিমা তখন বিরক্তির সুরে বলেন, দেখেন আমি আপনাকে টাকা দিতে বাধ্য নেই। এতিমের নামে টাকা তুলছেন নিজের পেট ভরতে। আবার ধর্মের সবক দিচ্ছেন। তাদের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। সব শুনে তারা বলেন, এভাবে মানুষজনদের ধরে ধরে বিরক্ত করা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষের বিরক্তির কথাটা তারা একবারও ভাবে না। ধর্মের দোহাই দেওয়ায় বিরক্তি লাগলেও অনেকে চুপ করে সহ্য করেন। প্রতিবেদকের পেশাগত পরিচয় জানতে পেরে নাসিমা আক্তার বলেন, ভাই আদায়কারীদের এ বিড়ম্বনা নিয়ে একটু লেখেন দয়া করে। যাতে এসব বন্ধ হয়।
//এআর