ঢাকা, সোমবার   ৩১ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

হাতের সঙ্গে হাতাহাতি

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ২১:২২, ৯ জানুয়ারি ২০২১

Ekushey Television Ltd.

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

হাত নিয়ে বড় সমস্যায় আছি। আসলে আমি যে এক জোড়া হাত বয়ে বেড়াচ্ছি, সে সম্পর্কেই তো সচেতন ছিলাম না দৈনন্দিন জীবনে। কিশোর বয়সে একবার খুব খারাপ করে হাত কেটেছিল আমার, তখন প্রতিনিয়তই আমার হাত জানান দিত যে, সে আছে। ভালো হয়ে যাবার পরে আবার হাতকে ফিরিয়ে দেয়া হলো বিস্মৃতির অতল জলে। সে ‘অতল জলের আহ্বান‘ তারপর শুনিনি বহুদিন।

কিন্তু কোভিড-১৯ সঙ্কট শুরু হওয়ার পরেই আমার হস্তদ্বয় পুনঃরায় আমার জীবনের মধ্যমণি হয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম যে, এই সঙ্কট সময়ে আমার হাত দু’টো আমার শত্রু-মিত্র দু’টোই। আমার হাত একদিকে যেমন আমার চরম শত্রু, অন্যদিকে তেমনি আমার পরম মিত্রও বটে। অনেকটা সেই ‘সর্প হইয়া দংশন কর,  ওঝা হইয়া ঝাড়োর’ মতো অবস্থা।

বারবার সতর্ক করা হচ্ছে যে, কোভিড সংক্রমণের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে আমার এতোদিন বিস্মৃত হওয়া হস্তদ্বয়। করোনার বীজ যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারে, তাতে ক্ষতি নেই। সেখানে বসে বসে একসময়ে সে নিজেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যে মুহূর্তে আমার হাত সে সংক্রমণ বীজ ধারণকারী বস্তু ছোঁবে- তা সে পোশাক-আশাকই হোক কিংবা দরজার হাতলই হোক, প্লাস্টিকের মগই হোক কিংবা কাঠের বাটিটিই হোক, সে মুহূর্তেই সে হস্তদ্বয় একটি মৃত্যুবাণ হয়ে যেতে পারে।

কারণ হাত তো নিঃসঙ্গ থাকতে পারে না। সে তার বান্ধব মুখের কাছে যাবেই, ছোঁবে মুখস্থিত নানান বস্তু- নাক, ঠোঁট, চোখ। ব্যস, তারপর থেকেই শুরু হয়ে যাবে কোভিডের তাণ্ডব। সংক্রমণের আভাস পাওয়া যাবে, উপসর্গ দেখা দেবে একে একে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আক্রান্ত মানুষটি সুস্থ হয়ে উঠবেন ধীরে ধীরে, কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হয়ে যাবে প্রাণঘাতী। বোঝাই যাচ্ছে, এ পুরো প্রক্রিয়ায় হাত দুটি যে আমাদের বড় শত্রু, তা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না- ‘সর্প হইয়া আমাদের দংশন করতে পারে।’

কিন্তু আবার এ পুরো প্রক্রিয়া প্রতিরোধে হাত আমার সবচেয়ে বড় মিত্র হয়ে উঠতে পারে। সবাই বলছেন যে, ক্রমাগত সাবান দিয়ে হাত ধুলে এবং হাত আর মুখের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটালে, এই সংক্রমণ-শেকল ভেঙ্গে দেয়া যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হস্ত প্রক্ষালনের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে হবে এবং বাইরে বেরুলে যে কোনও মানুষের সঙ্গে ন্যূনতম শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। 

বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডের জন্যে ন্যূনতম সময়ের জন্যে বাইরে তো বেরুতেই হবে- খাবার কেনার জন্যে, ওষুধ তোলার জন্যে, ব্যায়ামের জন্যে। কিন্তু বাইরে বেরুলে যদি ন্যূনতম শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যায় এবং সেই সঙ্গে যথাযথ প্রক্ষালনের সঙ্গে সঙ্গে হাতকে যদি পরিস্কার রাখি, তবে আমার হাত আমার সবচেয়ে বড় মিত্র হয়ে উঠবে- ‘ওঝা হইয়া ঝাড়বে’ এ দু:সময়ে।

সুতরাং বর্তমান সময়ে হস্ত নিয়ে সতত: ব্যস্ত আমি। যে হাতের অস্তিত্বই আমি প্রায়ই বিস্মৃত হয়েছিলাম- ঐ অনেকটা বাতাসের মধ্যে থেকে বাতাসের অস্তিত্ব ভুলে যাওয়ার মতোই- সেই হাতের পরিচর্যা করতে আমি সদাব্যস্ত এখন। কতবার যে সাবান দিয়ে হস্তদ্বয়কে ধুচ্ছি, কতবার যে তাতে পরিস্কারক লাগাচ্ছি, কত সময়ে যে তাকে দস্তানা দিয়ে ঢাকছি, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। হস্তপূজোই করছি দিন-রাত, শুধু ডান-হাতের ব্যাপার সারতেই নয়- বরং বেঁচে থাকতেই বলা চলে। শিব্রাম চক্কোত্তির ভাষায় - ‘হাতের সঙ্গে হাতাহাতিতেই’ ব্যস্ত আমরা সবাই।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি