ঢাকা, বুধবার   ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

হায়রে বচন!

প্রকাশিত : ১৩:১৩, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৩:৫১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মেয়েরা মেয়েদের শত্রু, মেয়েরা কুটনী, মেয়েরা স্বার্থপর, ছলনাময়ী, ঝগড়াটে, রহস্যময়ী, মেয়েদের পেটে কথা থাকে না, মাথা মোটা। মেয়েরা হিংসুটে, মেয়েদের মগজ হালকা, এরা ছিচকাঁদুনে, অন্যের ভালো দেখতে পারে না, এরা পরের বাড়ির জন্য, অংক পারে না, মেয়ে মানুষ বোঝা বড় দায়, ও’তো মেয়ে, পারবে না ইত্যাদি নানা মন্তব্য গল্পে আড্ডায়, আলোচনায় মুখরোচকভাবে বলা হয় মেয়েদের সর্ম্পকে। এসব কথা বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন অনেকেই।
সেই ছোটবেলা থেকেই পুরুষ শাসিত সমাজে এসব মন্তব্য শুনতে শুনতে মেয়েরা বড় হয়। এসব কথা শোনে সে পুরুষের কাছ থেকে, এসব কথা শোনে সে মেয়েদের কাছ থেকেও। তার শিশু মনে  দাগ কাটে কথাগুলো। কষ্ট পায় সে। কখনো প্রতিবাদ করে। কখনো কিছু বলতে পারেনা।কাঁদলেই যে তাকে বলা হবে ছিচকাঁদুনে। তখন অবচেতন মনেই এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে সে। নিজেকে সরিয়ে নেয়, গুটিয়ে নেয় সবকিছু থেকে। বাড়ির ছেলেদের চাইতে মেয়েটা মেধাবী হলেও সে তখন ভাবতে থাকে আসলেও সে বুঝি কিছু পারেনা। তার দ্বারা কিছু হবে না । হীনমনতায় তার জগত ক্রমশ ছোট হয়ে যায়। ছোট বেলাতেই কথার ইভ টিজিংয়ের শিকার হয় সে। যা চলতে থাকে সারাজীবন ভর।  
যারা কথাগুলো বলেন তারা ভাবেন না কি বিষ ছড়াচ্ছেন তারা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তারা ভাবতেও পারেন না  তাদের ছুড়ে দেওয়া কথাগুলো কিভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে পড়ছে নেতিবাচক অর্থে।
সেই আদিম যুগে পুরুষ নারী সমান তালে পা ফেলেছে। তারা বনে বাদারে এক সাথে শিকার করেছে। তখন বৈষম্য ছিলো না পুরুষ নারীতে।  এক সময় পুরুষ তার স্বার্থে পেশী শক্তির বড়াই করে নারীকে ঘরে বন্দী করে ফেলে। ছলনাময়ী, রহসময়ী মাথায় মগজ নাই ইতাদি নানা বিশেষনে ভুষিত করে তাকে দুর্বল করে রাখে। তার মানসিক শক্তিকে নষ্ট করে দেয়। ঘরই তার কাছে নিরাপদ আশয় বলে নির্ধারন করে দেয়া হয়। ফলে বাইরের আলো থেকে ক্রমশ বঞ্চিত হতে শুরু করে মেয়েরা। ধীরে ধীরে তার জগত হয়ে পরে সংকুচিত। আর তখনই মেয়েদের হালকা করে দেখতে শুরু করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। হেয় করে বলতে শুরু করে তারা নানা কথা।

মেয়েরা ছলনাময়ী, তাদের মাথা মোটা, তারা আবিস্কার করতে পারে না, বিজ্ঞান বোঝে না, অংক পারেনা নানা কথা বলা হয় তাদের সর্ম্পকে। ছেলেরা বংশের বাতি, মেয়েরা পরের বাড়ির জন্য। ছেলেবেলাতেই এসব কথা শোনে সে। তার মন ভেঙে যায়। তার কষ্ট দেখে শুধু রাতের আকাশ। পেটে গোপন কথা ছেলে মেয়ে অনেকেই হয়তো রাখতে পারেন না কিন্তু দোষ হয় শুধু মেয়েদের। তারা হালকা  পেটে কথা রাখতে পারেনা। এভাবে নানা ভাবে সমাজ তাকে হেয় করে। মেয়েদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয়।
সময় পাল্টায়। কিছু কিছু মেয়ে নিয়ম ভাঙে তারা আকাশে ওড়ে, ছুটে বেড়ায় দশ দিগন্ত। তবুও আজও পাল্টায় না মানসিকতা। যুগে যুগে হেয় করে বলা বচনগুলো চলতে থাকে মুখে মুখে। সিনেমা নাটক গল্পে হালকা সস্তা করে দেখানো হয় নারীদের। যেনবা মেয়ে মানেই কুটনী, স্বার্থপর, ঝগড়াটে, হিংসুটে। বিজ্ঞাপনে মেয়েদের দেখানো হয় লোভনীয় ভাবে। পন্য হিসেবে। কিন্তু কেন এসব বলা ?
এ কেমন মানসিকতা। যুগ যুগ ধরে একজন মেয়েকে শেখানো হয় অনের তৃপ্তিই তোমার  তৃপ্তি। ক্ষুধা লাগলেও তুমি না খেয়ে থাকবে । আগে খাবে বাড়ির ছেলেরা। বেহায়া মেয়েরা আগে খায়। বাসী খাবার নষ্ট করবে না। অকল্যাণ হয়। মায়ের বলে দেয়া কথাগুলো  শিখে নেয় মেয়ে। অথচ এই মা যদি পড়াশুনা করতেন তাহলে তার শেখানোটা হতো অনরকম ভাবে। তিনি বুঝাতে পারতেন পচা বাসী অস্বাস্থকর খাবার খাওয়া ঠিক না। ঠিক সময়ে খেতে হয় প্রতিটা মানুষকেই । এই মা কে শিখতে দেয়নি তার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কখনো কি পুরষরা জানতে চেয়েছেন তার স্ত্রীর কি ভালো লাগে ? সে খেয়েছে কিনা? তার সখ কি? সংসারের কোনো কারণে যদি বউ আর শাশুরির ঝগড়া লাগে বলা হয় মেয়েরা মেয়েদের শত্রু। একবারও ভাবে না তারা যে কোনো কারও সঙ্গে মতের মিল অমিল হতেই পারে। যে মা সারাজীবন তার রান্নাঘরকে তার সামাজ্য ভেবে জীবন পার করেছেন । তাকে আকড়ে ধরে একটু ক্ষমতা পেতে চেয়েছেন । তিনি হয়তো তা হারানোর ভয়ে অন্য আচরন করেছেন। যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে থাকার ফলে হয়তোবা সে তখন আর জায়গা ছাড়তে চায়না।

তখন তার ক্ষুদ্রতা, সংর্কীনতা চোখে পরে সবার। কিনতু তিনি যদি পড়াশোনা করতেন, চাকরী করতেন, বিশ^ ঘুরে দেখতেন তাহলে বুঝতেন এসব কত তুচছ বাপার কিনতু তাকে তো বুঝতে দেয়নি  সমাজ। রান্না ঘরেই কেটে যায় তার সারাজীবন। তথ্যের খোলা জানালা তাদের কাছে থাকে বন্ধ।  ফলে ভাবনার জায়গায় তারা হয়তো ছিলেন পিছিয়ে। সে বিষয়ে না যেয়ে সমাজ তাকে উপহাস করে ওতো মেয়ে মানুষ, ও পারবে না জ্ঞান বিজ্ঞান ওর জন্য নয়। যা শুনে মেয়েটি গুটিয়ে যায়। কারন তার পাশে তাকে সাহস দেবার তার আত্মবিশবাস বাড়িয়ে দেবার কেউ নেই। তার কান্না শোনে না বাড়ির কেউ। আমাদের দাদী নানী মায়েরা যদি জ্ঞানের আলোয় আরও হাটতে পারতেন পথ। আমাদের জন্য সে পথ তাহলে হয়তো আরও সহজ সরল হতো।

ধর্মীয় কুসংস্কার, পড়াশোনা,অর্থনৈতিক সক্ষমতার অভাবে হয়তো সব মেয়েরা তার মতামত সব জায়গায় দিতে পারে না। তবে সব সামাজিক সুযোগ সুবিধা পেয়েও অনেক পুরুষ যখন (সবাই না) কর্মক্ষেত্রে, ঘরে, সামাজিকভাবে সংকীর্ণ আচরন করেন তখন তাকে কি বলবেন ? তিনি তো অনেক সুযোগ পেয়েছেন। তার তো আকাশের মতো উদার হওয়া উচিত ছিলো ? তিনি কেন তা নন ? অন্যায় সব সময়ই অন্যায়। তা ছেলে মেয়ে সবার জন্যই। তাই নিজের সুবিধার জন্য, স্বার্থের জন্য নানা বিরুপ মন্তব্য করে মেয়েদের আর পিছিয়ে রাখা ঠিক হবে না। মেয়েদের আরও সচেতন, বুদ্ধিমান, সাহসী হতে হবে । মেয়েরা যত বাইরে আসবে, পড়াশোনা করবে, তত বন্ধ দুয়ার খুলে যাবে। খনা, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, ইলামিত্র, প্রীতিলতার দেশে বিরুপ মন্তব্য গুলোকে আবর্জনায় ফেলে আলো আনবেই মেয়েরা। তাই নারীদের পিছনে না রেখে রহস্যময়ী ছলনাময়ী, স্বার্থপর না বলে সবার আগে মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে সবাইকে।

/ এআর /



























** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি