ঢাকা, শনিবার   ০২ নভেম্বর ২০২৪

হুমকিতে দেশের একমাত্র কৃত্রিম আন্তর্জাতিক নৌ পথ

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ২০:৪৩, ১২ জুলাই ২০১৯ | আপডেট: ১৭:৫৯, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯

বর্তমানে একুশে টেলিভিশন’র নিজস্ব প্রতিবেদক। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি নিউএইজ, এনটিভি’র কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’র নেতৃত্ব দিয়েছেন। একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭’তে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আসমত আলীর অনশন’ প্রকাশিত হয়। তার বহু গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।

বিলুপ্ত ও বিলীন হওয়ার পথে দেশের একমাত্র কৃত্রিম আন্তর্জাতিক নৌ পথ। দেড় শত বছর আগে প্রায় আড়াই শতাধিক কিলোমিটার নৌপথ কমানোর লক্ষ্যে খনন করা হয় এ চ্যানেল। দীর্ঘ পথের বিকল্প হিসেবে চ্যানেলটি দিয়ে চলাচলের কারণে কমেছে যাতায়াত খরচ। বাণিজ্যিক জাহাজ থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী জাহাজের জন্য এ পথটি এক অনন্য দিশা হয়ে কাজ করে আসছে। কিন্তু সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে দেশের এই কৃত্রিম আন্তর্জাতিক নৌপথটি এখন হুমকি মুখে পড়েছে।

চ্যানেলটির নাম গাবখান চ্যানেল। যাকে বাংলার সুয়েজখালও বলা হয়ে থাকে। ১৮০০ সালের প্রথম দিকে ব্রিটিশ শাসনামলে ঝালকাঠির সুগন্ধা, বিশখালী ও ধানসিঁড়ি নদীর মোহনা থেকে পিরোজপুরের সন্ধ্যা নদী পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ চ্যানেলটি খনন করা হয়। সংযোগ করা হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালের সংগে খুলনা, মংলা, মোরেলগঞ্জ, হুলারহাট, যশোরের নওয়াপাড়া, নারায়ণগঞ্জ ও  ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বন্দর গুলোর। আড়াই শতাধিক কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে আনা হয়। তখন অবিভক্ত ভারতের সঙ্গে এ অঞ্চলের সঙ্গে নৌ যোগযোগ ও নৌ বাণিজ্যকে সহজতর করতে চ্যানেলটি খনন করা হয়েছিল। চ্যানেলটির ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়ের সঙ্গে নৌ-যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

কিন্তু দীর্ঘ দিন কার্যকর ড্রেজিং না করায় চ্যানেলটির নাব্যতা আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে, সেই সাথে মোহনাসহ বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে অসংখ্য ও ডুবো চর।

জলবায়ু ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ চ্যানেলটি রক্ষা করতে হলে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা দরকার ও দরকার যথপোযুক্ত তত্ত্বাবধান।

নাব্যতা হ্রাস, প্রতিটি বাঁকে চর জেগে ওঠা ও অসংখ্য ডুবোচরের কারণে বাংলার স্যুয়েজখাল খ্যাত দেশের একমাত্র অর্থকরী নৌপথ ঝালকাঠির গাবখান চ্যানেল দিয়ে যে কোন সময় নৌযান, জাহাজ বা কার্গো চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশংকা দেখা দিয়েছে।

গত ত্রিশ বছরে ড্রেজিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও পরিকল্পিত ড্রেজিং না হওয়া ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দেশি-বিদেশি নৌযানগুলো চ্যানেলটি দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। চ্যানেলের নাব্যতা ও প্রশস্ততা এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে এক সময়ের ডাবল ওয়ে (দ্বিমুখী) গাবখান চ্যানেল বর্তমানে ওয়ান ওয়ে (একমুখী) নৌপথে পরিণত হয়েছে।

প্রতি বছর বিপুল পরিমান রাজস্ব আয় হওয়া এ চ্যানেলের মৃতপ্রায় অবস্থার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল প্রধান সমুদ্র বন্দর মংলার সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নৌ যোগাযোগসহ নৌ-বানিজ্য হুমকির মুখে পড়েছে। জরুরি ভিত্তিতে চ্যানেলটি টেকসই সংস্কার না করা হলে সরকার যেমন রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি নৌপথে পন্য পরিবহনসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, এ চ্যানেল দিয়ে প্রতিদিন পণ্য ও যাত্রীবাহী দেশি-বিদেশি ১০০ থেকে ১২০টি জাহাজ চলাচল করে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, আশির দশকের শেষ পর্যন্ত গাবখান চ্যানেলটি প্রশস্ততা ছিল ২৫০ মিটারেরও বেশি। চ্যানেলের দুপাড় থেকে ক্রমশ ভরাট হয়ে এখন এর প্রশস্ততা ৮০ কি ৯০ মিটারে। কোন কোন জায়গায় তাও নেই। শুধু জোয়ারের সময় ঝুঁকি নিয়ে বড় নৌযানগুলি চলাচল করে।

পন্যবাহী জাহাজ বা কার্গো চলাচলের সময় নৌযানের তলা মাটিতে আটকে গেলে ব্যবসায়ীরা চরম বিড়ম্বনায় পড়েন। চ্যানেলটির সুগন্ধা মোহনা ও পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর (গাবখান সেতু) উত্তর পাশে বড় বড় চর জেগে উঠেছে। ভাটার সময়ে এ চ্যানেলে ৭ এবং জোয়ারের সময় পানি থাকে ১০ ফুট। তবে নিরাপদে নৌযান চলাচল করতে হলে ১২ থেকে ১৫ ফুট পানির প্রয়োজন হয়। পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে জোয়ারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুগন্ধা ও সন্ধ্যা নদীতে অপেক্ষা করতে হয়। ভাটার সময় ছোট ও মাঝারি নৌযান চলাচল করতে পারলেও বড় নৌযানগুলোকে বঙ্গপোসাগর হয়ে চলাচল করতে হয়।

দেশের দক্ষিনাঞ্চল বিশেষ করে উপকূলীয় আঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা এবং অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ নৌপথ বন্ধ হলে বেকার হয়ে যাবে আড়াই লাখ শ্রমিক। অর্থনীতির চাকা মন্থর হবে, বাড়বে পরিবহন খরচ।

১৯৫০ সালে মংলা বন্দর প্রতিষ্ঠার পর গাবখান চ্যানেলটি আন্তর্জাতিক নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ-ভারত নৌপথ প্রটোকল চুক্তির আওতায় দেশে প্রথম শ্রেণীর যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক নৌরুট রয়েছে, তার মধ্যে গাবখান চ্যানেল একটি।

এমভি সোনার বাংলা জাহাজের ক্যাপ্টেন সাফায়েত হোসেন জানান, প্রতি মাসে তেলবাহী কমপক্ষে ৭০টি জাহাজ এই পথ দিয়ে খুলনায় যায়। গাবখান চ্যানেলটি পূন: খনন বা ড্রেজিংয়ের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে বড় নৌযান ও জাহাজগুলোকে সুন্দরবন ও বরগুনা উপকূলের প্রায় ৫০০ কিলোমিটার ঘুরে গন্তব্যে যেতে হবে। এতে পণ্য পরিবহনের ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হবে। এতে অতিরিক্ত সময় ও অর্থ দুই ব্যয় হয়। ফলে পণ্যের দামের উপর পড়ে বাড়তি চাপ।

অপর এক নৌযান চালক বশির উদ্দিন জানান, এ চ্যানেলের ঝালকাঠির প্রান্ত থেকে প্রবেশ করার সময়েই বাধার মুখোমুখি হতে হয়। ভাটার সময় বড় নৌযানগুলো বাঁক নিয়ে গাবখান চ্যানেলে প্রবেশ করতে গেলে প্রায়শই দূর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। সারেঙ্গল, শেখেরহাট, মাজারসহ চারটি টার্নিং পয়েন্ট খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ভারতের হলদিয়াসহ ও দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলা এবং নওয়াপাড়ার সঙ্গে নৌ-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, এ চ্যানেলে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে টনপ্রতি ৮ টাকা হারে বছরে প্রায় ২ কোটি টাকা টোল আদায় করা হয়।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরিন নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ’র বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী (খনন বিভাগ) মো. সাইফুল্লাহ বলেন, ‘গাবখান চ্যানেলে গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দুই লাখ ঘনমিটার, ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে এক লাখ ঘনমিটার চর খনন করা হয়েছিল। এরপরও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় একবার খনন করা হলেও পলি জমে তা আবার অল্প দিনের মধ্যেই ভরাট হয়ে যায়। তাই এখন ড্রেজার দিয়ে চ্যানেলটি খনন করে যতোদূর সম্ভব নৌ-চলাচলের উপযোগী রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

জানা যায়, প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প সম্পন্নের তিন বছর পরেও চ্যানেলে এক সঙ্গে উভয়মুখী যান চলাচল কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়নি। উভয়মুখী নৌযান চলাচলের উপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০৪ সালে তৎকালীন সরকারের সময়ে ‘ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে গাবখান চ্যানেল প্রশস্তকরণ ও নাব্য উন্নয়ন` নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বিআইডব্লিউটিএ। ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় তা অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর ৪টি অর্থবছরের এ প্রকল্পে ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমাপ্ত হওয়া এ প্রকল্পের আওতায় ১৮ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে চ্যানেলটির তলদেশে প্রস্থ ২৬০ ফুট ও গভীরতা ১৪ ফুট করে প্রথম শ্রেণীর নৌপথে রূপান্তর করা হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। প্রকল্পটি শেষের পর চ্যানেলটিতে এক সঙ্গে উভয়মুখী নৌযান চলাচল শুরু হলেও কিছুদিনের মধ্যে তা পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। তখন প্রকল্প খননের নামে লুটপাটের অভিযোগ উঠলেও তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

ঢাকা-খুলনা রুটের রকেট (স্টিমার) চ্যানেলে ঢুকলে বিপরীত দিকে থেকে আসা সকল জাহাজের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। গভীরতা কমে যাওয়ায় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে চ্যানেলের বাঁক সিগন্যাল যথাযথভাবে মেনে একমুখী জলযান চলাচলের বেশ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে কর্তৃপক্ষ। কাউখালী ও ঝালকাঠী স্টিমার ঘাটে নৌ ট্রাফিক সিগন্যাল বসানো হয়। তবে সরকারি বা বেসরকারি নৌযানের কোনটাই এ সিগন্যাল অমান্য করে একপ্রান্ত থেকে ১টি জাহাজ প্রবেশের পর অন্যপ্রান্ত থেকে ২/৩টি জাহাজ প্রবেশ করে। এতে গত দুই বছরে নৌ ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করায় দুই শতাধিক জাহাজের বিরুদ্ধে কাউখালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।

প্রায় তিন দশক ধরে চ্যানেলে চর সৃষ্টি হলেও এ সময়ের মধ্যে টেকসই কোন ড্রেজিং করা হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, দুই-একবার ড্রেজিং করার পর মাটি তীরে না ফেলে খালেই ফেলা হয়।

নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত

তবে শুধু মাত্র ড্রেজিং করে গাবখান চ্যানেল রক্ষা করা যাবে না বলে মনে করেন নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। তিনি একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘শুধু ড্রেজিং করে গাবখান চ্যানেল রক্ষা করা যাবে না। নদী শাসন করতে হবে। এ জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।’

নদীগুলোর ধরন বা প্রকৃতি অনুযায়ী সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়া দরকার  উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এই গতি পথ ও প্রবাহ না বুঝে কাজ করলে তো তা দীর্ঘ মেয়াদি হবে না। নদীকে নদীর প্রবাহ অনুযায়ী চলতে দিয়ে এর প্রশস্থতা ও গভীরতা রক্ষা করতে হবে। ড্রেজিং করলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। পলি সরিয়ে ফেললেও কয়েক বছরের মধ্যে পলি আবার জমবেই।’ নদীগুলোর ধরন বা প্রকৃতি অনুযায়ী সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে মনে করেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত।

(প্রতিবেদনটি তৈরীতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ঝালকাঠি প্রতিনিধি আজমীর হোসেন তালুকদার)

এসি

 

 

 

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি