হ্যাপি কাপল!
প্রকাশিত : ১৬:৪০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ | আপডেট: ০৯:২৯, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
তমাল ওর আর সুমীর পাহাড়ে তোলা ছবিটা ফেসবুকে পোস্ট করতেই কমেন্টের ঝড় বয়ে গেল। কেউ লিখলো হ্যাপি কাপল, কেউ লিখলো এভারগ্রীন। কেউ লিখলো নাইস কাপল। কেউ লিখলো, আহা এমন ছবি দেখে মন ভরে যায়! প্রায় ৮’শ কমেন্টস পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমী। হায়রে নাইস কাপল। হায়রে হ্যাপি কাপল। গত ২দিন থেকে কথা বন্ধ তমালের সাথে ওর। চাকরি করা নিয়ে তুমুল ঝগড়া চলছে ওদের মধ্যে। তমাল চায়না ও আর চাকরি করুক। কিন্তু সুমীর ইচ্ছে নেই চাকরি ছাড়ার। এ নিয়ে চলছে ঝগড়া। মানসিকতায় মিলছে না বলে প্রতিদিনই ঝগড়া হচ্ছে ওদের। মাঝে মাঝে সুমির ইচ্ছে হচ্ছে সবকিছু ছেড়ে চলে যাবার।
ওদিকে এ ছবি দেখে মুখ ভার তমালের সহকর্মী শফিকের বউ মৌলির। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। আহা তমাল ভাই কত রোমান্টিক। দুজন চাকরি করে কি সুন্দর সময় বের করে ঘুরতে গেছে। সুমী ভাবিকে নিয়ে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে রোমান্টিক পোজে ছবি তুলেছে। আবার ক্যাপশনও দিয়েছে, আমরা দুজনা! এমন কথা কখনো লিখবে শফিক? কক্ষনো না। ছবিই তুলতে চায় না। আবার ডায়ালগ দিবে। গজগজ করে ও। শফিক বাসায় আসতেই খোঁচা মেরে কথা বলে ও। দেখো, দেখে শেখো। তমাল ভাই কি রোমান্টিক ছবি পোস্ট করেছে। তুমি কখনো আমাকে নিয়ে এমন ছবি পোস্ট করেছো? যতই বোঝাতে চায় শফিক। কদিন আগেই তো মৌলির সাথে ছবি দিয়ে ফেসবুকে কাভার পেজ করেছে। ততই রাগ করে মৌলি। সে তো সেই কবে, পাহাড়ে তো আর নিয়ে যাওনি। ফলাফল রাতে কথা বন্ধ।
ছেলেমেয়ে দুজন চুপচাপ খেয়ে পড়তে বসে। বোঝে তারা বাসার আবহাওয়া আজ খুব একটা ভালো না। ওদিকে পারভেজ সাহেব তার বস শফিক আর মৌলির ভাবীর ছবি দেখে মুগ্ধ। ভাবেন আহা কত প্রেম স্যারের। বউয়ের সাথে কি সুন্দর সমুদ্রের পাড়ে ছবি তুলেছেন। কি সুন্দর মৌলি ভাবী। আজ তার স্ত্রীকে বড় মলিন লাগে। ফর্সা পাতলা মুখটা মনে হয় বয়স্কা। এতদিন যে ফর্সা রঙকে মনে হয়েছিল দুধে আলতা। আজ মনে হচ্ছে বড় বেশি যেন সাদা। আরেকটু শ্যামলা হলে ভালো হতো। ওই যে মৌলি ভাবীর মতো। কি মিষ্টি মুখখানা। দেখা হলেই কি মিষ্টি মিষ্টি কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা লাভ ইমো দেন তিনি। লেখেন ফ্যান্টাসটিক......মেড ফর ইচ আদার। কপাল কুচিয়ে ভাবেন সবাই কত হ্যাপি কাপল। শুধু তিনিই দু:খী। ফেসবুকের নোটিফিকেশন বন্ধ করে মনখারাপ করে শুয়ে পড়েন।
ওদিকে রাজিব আর তামান্না একই অফিসে চাকরি করে। দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠেছে একটা সর্ম্পক। দুজনেরই ফেসবুক ওয়ালে দেয়া আছে পরিবারের সাথে হাসিমুখের ছবি। সে ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কবীর সাহেব। আহা... কি মায়াময় পরিবার। শক্ত বাঁধনে বাঁধা।
কাশবন থেকে ফিরে ফেসবুকে ছবি পোস্ট দেয় রিমু। কাশবনে নীল শাড়ি পরা। ট্যাগ করে রুবেলকে। রুবেল মুগ্ধ হয়ে দেখে দুজনের ছবি। মনে মনে ভাবে, জীবনকে সাজাতে মাঝে মাঝেই রিমুকে নিয়ে বেড়াতে যেতে হবে। লাভ ইমো দেয় ও। কমেন্টস পড়তে থাকে।
সুপ্রিয় পাঠক, উপরের সবগুলো ঘটনাই সত্যি। লেখার প্রয়োজনে নামগুলো শুধু পালটে দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে ফেসবুকে হ্যাপি কাপলের ছবি দেখে অসংখ্য দম্পত্তি গোপনে এমন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তারা অনেকেই ভাবেন তারাই বুঝি দু:খী আর পৃথিবীর সবাই খুবই হ্যাপি কাপল।
আসলেই কি তাই? ফেসবুকে হাসি হাসি রোমান্টিক মুডে ঘুরে বেড়ানো, পাশাপাশি হাত ধরে, মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম টাইপের ছবি দিলেই কি হ্যাপি কাপল হওয়া যায়?
প্রশ্ন করেছিলাম গৃহিনী আফরোজা হোসেনের কাছে। তিনি জানান, মাঝে মাঝে ফেসবুকে ছবি দেখে যে মন খারাপ হয় না তা না। যখনই বন্ধুদের বরের সাথে ছবি দেখি তখন ভালো লাগে আবার সাথে সাথে মনে হয় আমার স্বামী তো এমন করে না। তখন নিজেকে একটু দুঃখী দুঃখীই লাগে। রাগ হয় বরের উপর। জীবনে কিছুই পেলাম না মনে হয়ে আফসোস হয়।
বেসরকারি চাকরিজীবী সেতু বলেন, শোনেন আমার অফিসের এক কলিগ সারাদিন তার স্ত্রীর বদনাম করেন। কিন্তু ফেসবুকে কাভার পেজে তার সাথে হাসিমুখের ছবি দিয়ে রেখেছেন। তাদের ম্যারেজ ডে, জন্মদিনের ছবি দেন গাদা গাদা। এরা কি হ্যাপি কাপল? হ্যাপি কাপল হলে কি বাইরে স্ত্রীর বদনাম করেন?
ব্যাংকার সঞ্চিতা বলেন, ফেসবুকের হাসিমুখের ছবিই কিন্তু প্রমাণ করে না তারা হ্যাপি কাপল। হ্যাপি তারাই যাদের নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। তারা ছবি দিলেই কী আর না দিলেই কী, তারাই আসলে হ্যাপি। তাদের সর্ম্পকের জোরটা অনেক। সেখানে হাসিমুখের ছবি মুখ্য না।
সংস্কৃতিকর্মী সাইদ হাসতে হাসতে বলেন, ফেসবুকে অন্যদের ছবি দেখতে ভালই লাগে। নিজেদেরটাও দেই। যে ছবি ভালো হয় সেই ছবি দেই। আসলে নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ওপারেতে সব সুখ আমার বিশ্বাস। সুখ আসলে থাকে নিজের মনের ভেতর, বাইরে নয়।
সাংবাদিক বন্ধু জয়া (ছদ্দনাম) হাসতে হাসতে বলে, ‘জানেন, সেদিন এক পুরুষ সহকর্মী বলে কি আমার ওয়াইফ স্মার্ট না। বোকা, সুন্দর করে কথা বলতে পারে না। আপনারা কত স্মার্ট।’ সে সময় ওনার স্ত্রী ফোন করতেই তিনি বলেন, ‘জান, তোমার কথাই বলছিলাম। খেয়েছো তুমি?’ জয়া বলে, ‘এই হচ্ছে এখন হ্যাপি কাপলের নমুনা। তার মতে, ফেসবুকে মানুষ নিজেকে শো আপ করে। এটা করুক তবে সাথে সাথে আসলে ভালো সর্ম্পক রাখার চর্চাটাও করা উচিত।
বেসরকারী কর্মকর্তা রায়হান বলেন, ফেসবুকে ছবি দেয়াটা দোষের কিছু নয়। সে মনে মনে ভাবতেই পারে সে সুখী। এর দেয়ার মধ্য দিয়েও সে হয়তো কিছুটা সুখ পায়। পাক না। এতে ক্ষতি তো নেই। তাকে দেখে অন্যরাও তো হ্যাপি হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তার কথার সূত্র ধরে লিটা বলেন, ছবি দিতেই পারেন দম্পতিরা তবে ঘরে স্ত্রী বা বরকে নির্যাতন করে, মিথ্যে বলে পরে হাসি মুখের ছবি পোস্ট করা তো ভণ্ডামি। এটা কি এক ধরনের সামাজিক প্রতারণা না?
কর্পোরেটে চাকরি করা জাকারিয়া করিম বলেন, আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে সুখী নয়, সুখে আছি এটা দেখানোটা যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে যে সর্ম্পকের ভীত হওয়া দরকার ছিল শক্ত। তা আজ নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। ছুটির দিনে আউটিং, ডিনারে বাইরে খাওয়া, কাশবনে ছবি দেয়া এসব এখন দেখানো টাইপের হয়ে গেছে। গড্ডালিকায় ভাসছি আমরা। খাওয়ার সময় এত ছবি না তুলে নিজেরা যদি খুনসুটি করেন সেটাই হচ্ছে আসলে কোয়ালিটি টাইম। এ বিষয়গুলো থেকে আসলে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। ফলে হ্যাপি কাপলের সংজ্ঞাটাও পালটে যাচ্ছে আজকাল। হ্যাপি হয়েও তখন আসলে আর হ্যাপি হচ্ছি না। নানা ধরনের নাগরিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হচ্ছি প্রতিনিয়ত।
বেসরকারি চাকরিজীবী সুমিতা চৌধুরী বলেন, বৌ এর কাঁধে মাথা রেখে, হাত ধরে তুমি আমার, আমি তোমার মার্কা ছবি দেয় অনেকেই। আর তার পরেই লুকিয়ে অন্য মেয়ের সাথে চ্যাটিং করে। এসব দেখে ফেসবুকে সর্তক বার্তা দিয়েছি, এখন থেকে আমাকে কেউ নক করলে স্কীন শট নিয়ে তাদের বৌকে পাঠিয়ে দিব। তখন বুঝবে ভণ্ডামি ভালবাসা কাকে বলে।
জয়িতার মতে, ফেসবুকে হ্যাপি কাপলের ছবি দেখলে যে সবাই ঈর্ষান্বিত হয় তা না। এটা ডিপেন্ড করে মানসিকতার উপর। নিজেদের মধ্যে যদি পারস্পারিক বিশ্বাস আর বোঝাপড়া দৃঢ় হয় তাহলে কোনো ছবি তাদের মনে চির ধরাতে পারে না। আমাদের তো কিছু মনে হয় না। বরং ফেসবুকে হাসি হাসি প্রেমময় ছবি দেখতে ভালোই লাগে।
সংগীত শিল্পী খালকিন জাদিদের মতে, হ্যাপি হতে গেলে আসলে প্রতিনিয়ত চর্চা করতে হয়। একদিনে তা হয় না। আরেকজনের সুখ দেখে কখনোই তুলনা করা উচিত না। একেকজন একেকভাবে সুখী হয়। আর সংসারে দুজনকেই চেষ্টা করতে হয় সুখী হতে। ফেসবুক কখনোই সুখী দেখানোর মাধ্যম হতে পারে না।
সমাজবিজ্ঞানী নফিসা কবীর বলেন, অন্যের ওয়ালে ছবি দেখে ঈর্ষান্বিত না হয়ে নিজেরা মিলে আসলে গড়া যায় সুখ। এর বউ ভালো, না ওর বর ভালো, এ রোমান্টিক, না সে রোমান্টিক সে হিসেবে না গিয়ে নিজের বর আর বউকেই বাসা দরকার ভালো। যাকে মনে করছেন আদর্শ কাপল।
সেই কাপলে যে ঘুণে ধরা নেই তা কি আপনি জানেন?
তাই অন্যের ছবি দেখে, অন্যের বর বউয়ের ছবি দেখে, মন খারাপ নয়, কষ্ট পাওয়া নয়, সংসারে অশান্তিও নয়। নিজ পরিবারে স্বচ্ছতা, বিশ্বাস আর ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে তুলুন। সত্যিকার ভালোবাসার নরম আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ুক সব হ্যাপি কাপলদের মাঝে।
লেখক: সাংবাদিক
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।