৭ মার্চ ছিল অনিবার্য
প্রকাশিত : ১৪:১০, ২৫ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৪:১২, ২৫ জুন ২০২০
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা।
অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আলোচনাকালে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ৭ মার্চ কি অনিবার্য ছিল? বিষয়টি নিয়ে আগে কখনও গভীরভাবে চিন্তা করিনি। সাতই মার্চ তো সাতই মার্চ। পরে ভেবে দেখলাম, প্রশ্নটি তাৎপর্যময়। ঘটনা পরম্পরা আলোচনা করলে দেখা যাবে ৭ মার্চ ছিল অনিবার্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আরও অনেকে ১৯৪৭ সাল থেকেই পৃথক একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের কথা বলেছিলেন। স্বপ্নও হয়তো দেখেছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু শুধু স্বপ্নই দেখেননি বা বলেননি, কীভাবে তা কার্যকর করা যায় সেটিও ভেবেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৬৯ সাল এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সবাইকে মুক্ত করার মাধ্যমে বাঙালি আরেকটি ধাপ এগিয়েছিল। অর্থাৎ এটি ছিল দ্বিতীয় পদক্ষেপ।
অন্যদিকে, ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঝড়ের পর ইয়াহিয়া সরকার বাঙালিদের ত্রাণ কাজে তৎক্ষণাৎ এগিয়ে আসেনি। পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘোষণা করলেন- ‘ওরা কেউ আসেনি।’ শামসুর রহমান সেই জনসভা প্রত্যক্ষ করে লিখলেন- ‘সফেদ পাঞ্জাবি। এল নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ম্যান্ডেট পেল বাঙালির ৬ দফা কার্যকর করার। সুতরাং একধরনের মানসিক প্রস্তুতি ছিল সবার। একথা ভুললে চলবে না যে, ১৯৬৯ সালেই শ্লোগান উঠেছিল- ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা।’ ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশনের ঘোষণা বাঙালির মনস্থির করতে সাহায্য করে। বিষয়টি এমন—যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। ১ মার্চ থেকে ৭ মার্চ যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা বিশ্লেষণ করলেই মনস্থির করার বিষয়টি বোঝা যাবে। সবকিছু মিলে অনিবার্য করে তুলেছিল ৭ মার্চ। ১-৬ মার্চের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলেও তা প্রমাণিত হবে।
স্বাধীনতার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কোনো দ্বিধা ছিল না, তবে তিনি ধীরস্থিরভাবে এগোতে চেয়েছিলেন। প্রথমে তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন যাতে ভবিষ্যতে কেউ বলতে না পারে, তিনি একতরফা কাজ করেছেন। এ দূরদর্শিতা পরে বাংলাদেশ আন্দোলনে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে মানুষের প্রতিবাদ বিক্ষোভেও বাধা দেননি। আমরা তখন ছাত্র। তরুণদের প্রবল চাপ ছিল তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার। কি বঙ্গবন্ধু তাদের আরেকটি সুযোগ দিতে চেয়েছেন নিজের দাবিতে অনড় থেকে। সব মিলিয়ে ৭ মার্চ স্বাধীনতা ও মুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন। সাক্ষ্য করবেন, তিনি শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতাই চাননি, সাধারণ মানুষের মুক্তিও চেয়েছিলেন।
১ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা চলছে বিসিসিপি ও আন্তর্জাতিক একাদশের ক্রিকেট খেলা। স্টেডিয়াম প্রায় ভর্তি। চাপা টেনশন থাকলেও শহর শান্ত। বেলা ১টার সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার-ভাষণ দিলেন, যার মূল কথা ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত। বেতাৱা-ভাষণটি শেষ হতে-না-হতেই পুরো শহরটি বদলে যেতে লাগল। যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে শহর। ‘ইত্তেফাক’ থেকে আমরা ক’জন বেরিয়েছি রাস্তায়। এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে ছোট ছোট মিছিল—যাচ্ছে গুলিস্তান, পল্টন। পূর্বাণী হোটেলের সামনে মিছিল আর স্লোগান। “জয় বাংলা”, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদা-মেঘনা-যমুনা’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা’…।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ পণ্ড। খেলোয়াড়রা দৌড়ে আশ্রয় নিয়েছে ড্রেসিংরুমে। টেডিয়ামের কোথাও কোথাও জ্বলছে আগুন। সব মানুষ যেন রাস্তায়। হোটেল পূর্বাণীর সামনে লোকে লোকারণ্য। বিকাল ৩টায় সেখানে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক। বঙ্গবন্ধু ক্রুদ্ধ জনতাকে শান্ত হতে বলে দু’দিনের কর্মসূচি দিলেন আর বললেন, ৭ মার্চ হবে জনসভা। সেখানে তিনি তার বক্তব্য দেবেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির স্থপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘১ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন।’
১ থেকে ৭ মার্চ প্রতিদিন কিছু-না-কিছু ঘটতে থাকে ঢাকা শহরে, সারাদেশে। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-জনতার সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ আর গগণবিদারী স্লোগান- ‘জয় বাংলা’, ‘জ...য়...বাং...লা’। সন্ধ্যায় জারি করা হয় কারফিউ। মানুষ বলে ‘জয় বাংলা’ আর রাস্তায় নামে, মানুষ বলে তোমার-আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা আর কারফির ভাঙে, মানুষ বলে ‘জয় বাংলা’ আর গুলি খায়, আবারও বলে ‘জয় বাংলা’, আবারও গুলি খায়। হাসপাতালে বুলেটবিদ্ধ মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে আর গভীর রাতে শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশে আগুন জ্বালাবেন না। যদি জ্বলান, সে দাবানল থেকে আপনারাও রেহাই পাবেন না। …সাবধান, শক্তি দিয়ে জনগণের মোকাবেলা করবেন না।’
একাত্তরের ৩ মার্চ। আগের রাতের শহীদদের নিয়ে মিছিল বের হয়। পল্টনে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই বচনা করব।’ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে পল্টনের চারদিক। শেখ মুজিব বললেন, ‘বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য, গুলি খাওয়ার জন্য নয়। গরিব বাঙালির টাকায় কেনা বুলেটের ঘায়ে কাপুরুষের মতো গণহত্যার বদলে অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিন। …২৩ বছর ধরে রক্ত দিয়ে আসছি। প্রয়োজনে আবার বুকের রক্ত দেব। মৃত্যুর মুখে দাড়িয়ে বীর শহীদদের সঙ্গে বেঈমানী করব না।’ বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন— ‘ভায়েরা, আবার আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তারাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউ না থাকে, তবু আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।’ চারদিক থেকে গগনবিদারী গর্জন শোনা যায়— ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’।
রাতে সারাদেশে মানুষ কারফিউ ভেঙে নেমে আসে রাস্তায় আর বলে, ‘জয় বাংলা’। খালি বলে ‘জয় বাংলা’। ৭৫ জন লাশ হয়ে পড়ে থাকে রাস্তায়, অগণিত কাতরাতে থাকে গুলি খেয়ে- তবুও বলে ‘জয় বাংলা”। ৭ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধু চিৎকার করে বলেছে ‘জয় বাংলা’। আর বদলে পেয়েছে গুলি। আমরা ভাবছি কী বলবেন শেখ মুজিব? তিনি কি বলবেন, বাংলাদেশ হয়ে গেছে স্বাধীন? কিন্তু বলার আর বাকি কী? বরং তিনি যদি না বলেন, তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাবে মানুষ। ইতিমধ্যে উত্তোলিত হয়েছে স্বাধীন বাংলার পতাকা আর বাংলাদেশ ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সেই গগনবিদারী আওয়াজে ‘জয় বাংলা’! ‘জয় বাংলা’!
ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী বলবেন তা ঠিক করার জন্য ৬ মার্চ বসল আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভা। সারাদেশে প্রত্যাশা দেখা দিয়েছিল যে, ৭ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। বস্তুত ছাত্র ও যুবসমাজ এ ধরনের ঘোষণার প্রবল পক্ষপাতী ছিল। ৭ মার্চ নাগাদ দলীয় সদস্যদের মধ্যে সামান্যই সন্দেহ ছিল যে, ছাত্রসমাজ, যুবসম্প্রদায় এবং রাজনীতি সচেতন ব্যাপক জনগণের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনোকিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না।’
সুতরাং দল ও দলীয় নেতা শেখ মুজিবের ওপর দায়িত্ব এসে পড়েছিল এমন কিছু না বলা, যা পাকিস্তানি পক্ষকে তখনই অজুহাত দেবে অপ্রস্তুত জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার। আবার একই সঙ্গে চাঙ্গা রাখতে হবে আন্দোলন ও জনগণকে। এ ভারসাম্য বজায় রাখা নিতান্ত সহজ ছিল না। এছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, তখনও তাকে কাজ করতে হচ্ছিল পকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে যেখানে তার অবস্থান ছিল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। এখন আমাদের কাছে ব্যাপারটি যত সহজ মনে হচ্ছে, তখন নিশ্চয় তা ছিল না। এছাড়া ছিল তরুণ, বিশেষ করে ছাত্রদের প্রবল চাপ। তারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ফেলেছেন। আন্দোলনের তারাই ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। তাদের বিরূপ করা সম্ভব ছিল না।
৭ মার্চ দুপুর থেকে ঢাকা শহর এগোতে থাকে রমনা রেসকোর্সের দিকে। মনে আছে, রেসকোর্সের এককোণে আমি, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও রফিক নওশাদ বিক্রি করছি সারারাত ধরে ছাপা লেখকদের মুখপত্র ‘প্রতিরোধ’, যার হেডলাইন ‘আপসের প্রস্তাব আগুনে জ্বালিয়ে দাও’ এরকম একটা কিছু।
বিকাল ৩টার মধ্যে লোকে লোকারণ্য। রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশন এখনকার মতো তখনও ছিল সরকারি। শেখ মুজিব জেনেশুনেই বলেছিলেন- ‘মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনেন তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয় কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না।’
রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারের বন্দোবস্ত করল। পাকিস্তানি সেনা অফিসার সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘রেডিওর ঘোষকরা আগে থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাতদৃঢ় লাখ দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা জার করতে শুরু করল।’ সালিক আরও লিখেছেন, এ ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসকের দফতর হস্তক্ষেপ করে এ বাজে ব্যাপারটি বন্ধের নির্দেশ দিল। সালিকও তা রেডিও কর্তৃপক্ষকে জানালেন। আদেশটি শুনে টেলিফোনের অপরপ্রান্তে বাঙালি অফিসারটি বললেন, ‘আমরা যদি সাড়ে ৭ কোটি জনগণের কণ্ঠ প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করব না।’ এ কথার সঙ্গে সঙ্গে বেতারকেন্দ্র নীরব হয়ে গেল। বাঙালি সে সময় এ ধরনের সাহস দেখানোর ক্ষমতা দেখিয়েছিল। কারণ তারা শেখ মুজিবের ওপর এই বিশ্বাস স্থাপন করেছিল যে, তিনি বিশ্বাস ভঙ্গ করবেন না। রেডিওতে ভাষণটি অবশেষে প্রচারিত হয়েছিল। শেখ মুজিব এসে মঞ্চে উঠলেন। সারা রেসকোর্স কাঁপিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মতো সেই শব্দটি বয়ে গেল— ‘জয় বাংলা’!
বঙ্গবন্ধু মঞ্চে ওঠেন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট পরেন। আমরা যারা টিএসসির মোড়ে, তারা দূর থেকে ঝাপসা একটি অবয়র দেখি। সভায় কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। কালো ভারী ফ্রেমের চশমাটি খুলে রাখলেন ঢালু টেবিলের ওপর। শান্ত গম্ভির কণ্ঠে বললেন, ‘ভায়েরা আমার! আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন, সবই বোঝেন।’
উনিশ মিনেটের ভাষণ, লিখিত নয়। কিন্তু একবারও থমকাতে হয়নি। পরে বিবিসি’র ভিডিওতে ক্লোজআপ শটে দেখেছি আবেগে কাঁপছে তার মুখ, কিন্তু গোটা অবয়বে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ। বোঝা যায় তিনি পিছোবেনে না।
৭ মার্চ যিনি রেসকোর্সে ছিলেন না, তাকে বোঝানো যাবে না ৭ মার্চ কী ছিল বাংলাদেশের জন্য। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ বাঙালি মাত্রই জানেন। এ ভাষণের প্রতিটি উক্তিই উদ্ধৃতিযোগ্য। কিন্তু মূল বক্তব্যটি ছিল— ‘আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা কোরো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।’ সবশেষে বললেন, যা শোনার জন্য উন্মুখ ছিল বাংলাদেশ— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
কঠিন সংকটে এত ভারসাম্যপূর্ণ অথচ আবেগময় বক্তৃতার সংখ্যা বিরল। কীভাবে তিনি তা পেরেছিলেন, আজ ভাবলে অবাক লাগে। পাকিস্তানি সৈনিক সিদ্দিক সালিক লিখেছেন- ‘বক্তৃতার শেষদিকে তিনি জনতাকে শান্ত এবং অহিংস থাকার উপদেশ দিলেন। যে জনতা সাগরের ঢেউয়ের মতো প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে রেসকোর্স ভেঙে পড়েছিল- ভাটার টান ধরা জোয়ারের মতো তারা ঘরে ফিরে চলল। তাদেরকে ধর্মীয় কোনো জনসমাবেশ তথা মসজিল কিংবা গির্জা থেকে ফিরে আসা জনতার ঢলের মতোই দেখাচ্ছিল এবং ফিরে আসছে তারা সন্তুষ্টচিত্তে- ঐশীবাণী বুকে ধরে। তাদের ভেতরকার সেই আগুন যেন থিতিয়ে গেছে। ইচ্ছা করলে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে সেই আগুনকে ধাবিত করা যেত। আমাদের অনেকেরই আশঙ্কা ছিল এরকমই। এ বক্তৃতা সামরিক আইন সদর দফতরে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিল। সদর দফতর থেকে টেলিফোনে কথোপকথনকালে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, এখন সামরিক আইন প্রশাসক বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ।’
বিএনপির স্বপ্নদ্রষ্টা জিয়াউর রহমান লিখেছিলেন, ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক ‘গ্রীন সিগন্যাল’ বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পকিস্তানি সৈনিকদের মাঝে উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠেছিল।’
মঈদুল হাসান লিখেছেন, ‘সম্ভবত তিন সপ্তাহাধিক কালের অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ারে বাংলার সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় এমন এক মৌল রূপান্তর ঘটে যে, পাকিস্তানিদের নৃশংস গণহত্যা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতাই তাদের জন্য অভিন্ন ও একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ মানুষের কাছে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ঘোষণা হয়ে ওঠে এক অভ্রান্ত পথনির্দেশ।
এ ভাষণের পর শুধু ঢাকা শহর নয়, পুরো দেশটি বদলে যায়। বাষ্পে ভরা পাত্রের মতো টগবগ করতে থাকে ৭ কোটি মানুষ। জোরদার হয়ে ওঠে অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। শেখ মুজিবের নির্দেশই হয়ে ওঠে সরকারি নির্দেশ। মানুষ তা মানতে থাকে। এমনকি সরকারি প্রশাসনও।
এভাবেই সৃষ্টি হয় একটি সমান্তরাল রাষ্ট্রের। সেদিক বিচার করলে ২৫ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল একটি ফর্মাল ডিক্লারেশন যাত্র। আসলে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের পত্তন হয় ৭ মার্চ। মহাত্মা গান্ধীও এত স্বল্পসময়ে এত পরিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন করতে পারেননি। যারা পিছিয়ে ছিল এতদিন, ভুগছিল দোদুল্যময়তায়, তারাও এগিয়ে আসতে থাকে। কী জানি ক্যারাভান যদি তাদের ফেলে এগিয়ে যায়। এভাবেই বাংলাদেশ এগোতে থাকে ২৫ মার্চের দিকে। ওই যে সেদিন শেখ মুজিব আঙুল তুলে নির্দেশ দিয়েছিলেন, বাঙালি তা মেনে চলে গিয়েছিল। পরাধীন পাকিস্তানে আর তারা ফিরে আসেনি।
লেখক- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ।
এনএস/